আইন মন্ত্রণালয়ের মন্দ কপাল

অর্থমন্ত্রীর ৭ জুনের বাজেট বক্তৃতার পর স্বাভাবিকভাবেই দেশে বইছে আলোচনার ঝড়। এবার আলোচ্য বিষয়ের শীর্ষে ব্যাংক খাত। সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা, প্রতিরক্ষা ও আরও কিছু বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। তার ওপর চাপ বাড়ছে, দাম বাড়ছে বা কমছে ইত্যাদি স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় আসছে। এটা জনগণের বাজেট, উন্নয়নের বাজেট, উন্নয়নশীল দেশের বাজেট, অর্থাৎ অত্যন্ত ভালো বাজেট। মন্ত্রিকুলসহ একপক্ষের এহেন মূল্যায়ন। অন্যপক্ষ বলছে, গেল গেল, সব গেল। মাঝখানে দাঁড়িয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, কিছু এসেছে, কিন্তু গিয়েছে অনেক বেশি। যেটা গেলে ভালো হতো, সেটা যাচ্ছে না, বৈষম্য যাচ্ছে না বা কমছে না, বরং বাড়ছে। গরিবেরা আরও গরিব হচ্ছে আর ধনীদের সহায়–সম্পদ বাড়ছে অনেক বেশি দৃঢ় ও দ্রুতগতিতে।

‘হায় রে কপাল মন্দ,’ আমাদের কথা কেউ বলে না। বিচারপতি, বিচারক, আইনজীবী, আইন, মামলা, মামলার জট, কোনো কিছুই বাজেট আলোচনায় স্থান পায় না। অনুমেয় আইন, বিচার ইত্যাদি তাচ্ছিল্যকর বিষয়বস্তু, তবে এটাও সত্য, শিক্ষা নিয়ে শিক্ষাবিদেরা কথা বলেন; স্বাস্থ্য নিয়ে চিকিৎসক-নার্স বলেন; ব্যাংকের মালিক বা পরিচালকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে (যেমন করপোরেট ট্যাক্স শতকরা আড়াই ভাগ কমেছে) তাঁরা থলে থলে টাকা নিয়ে বাজেটের আগে দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ফলও পেয়েছেন; ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িতদের হুলুস্থুলের কারণে তাঁদের ওপর ৭ জুন বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত শতকরা পাঁচ ভাগ কর পরদিন শুক্রবারই প্রত্যাহার করা হয়েছে। যে যাঁর সেক্টর নিয়ে কথা বলবেন, দাবিদাওয়া পেশ করবেন, দেনদরবার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। হায় রে, আমাদের কপালটা মন্দ।

কমবেশি দেড় যুগ আগের কথা। বাজেটের কিছু আগে তখনকার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে একটু কথা হয়েছিল। কোন আইনমন্ত্রী, সেটা ঘুণাক্ষরেও ইঙ্গিত দেব না, দিনকাল খারাপ। সেই আইনমন্ত্রীর কোনো এক তাঁবেদার হঠাৎ যদি মনে করে ফেলেন আমি কটাক্ষ করছি, তাহলে কপালে মামলার দুঃখ আছে। রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীকে কটাক্ষ করার জন্য বিশ্বে কোথাও ফৌজদারি মামলা হয় বলে জানা নেই। কিন্তু আমরা বাস করছি অদ্ভুত এক দেশে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষ মারলে কিছুই হয় না, কিন্তু কটাক্ষ করলে ত্বরিত গ্রেপ্তার ও কারাগারে প্রেরণ। কটাক্ষ করে এত বড় ক্ষতি ও নৃশংস কাজ করেছেন যে ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দেবেন না, দায়রা জজও বলবেন জামিনের আবেদন নামঞ্জুর। হাইকোর্ট করেন, আপিল বিভাগ পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি। ব্যাপারটা নিয়ে আপিল বিভাগ দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চিন্তাভাবনা করে আইন–নজির ঘেঁটে অত্যন্ত সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। ধাপে ধাপে দেশের ও রাষ্ট্রের বাঘা বাঘা আইনজীবী ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন আইনি বয়ান ঝাড়বেন। অতএব, পাঠক, বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কত গভীর ও জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। অধম এতে জড়াতে চাচ্ছি না। অতএব, আইনমন্ত্রীর নাম বলব না।

আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, বাজেট তো অর্থমন্ত্রীর ব্যাপার, আমি জেনে কী করব? বলতে চেয়েছিলাম, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় তো আপনার ব্যাপার, আপনার মন্ত্রণালয়ের জন্য বছরে কী কী খাতে, যেমন বিচারকদের বেতন, আদালত ভবন নির্মাণ, মেরামত থেকে শুরু করে সারা বছরে পেনসিল-কলম-কাগজ-খাতা, গাড়ি, গাড়ির জ্বালানি, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত, অর্থাৎ আলপিন থেকে আদালতের চৌদ্দতলা ইমারত পর্যন্ত কত টাকা লাগবে, সেই হিসাব তো অর্থমন্ত্রীকে আপনিই দেবেন এবং এত টাকা কেন লাগবে, সেটাও আপনিই বোঝাবেন। তবে কিছুই বলিনি।

২.

এবার হিসাবে আসি। দৃষ্টান্ত হিসেবে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ বাজেটের তুলনামূলক অবস্থা লক্ষ করা যাক: ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ২১৯ কোটি টাকা আর মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য ছিল ১ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রথমটি ছিল ১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, দ্বিতীয়টি ১ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা এবং আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৫২১ কোটি ও ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।

স্পষ্টতই দেশ, জাতি ও সরকারের জন্য আইন-বিচারের থেকে মাছ-মাংসের গুরুত্ব অনেক বেশি। কিছু কাজ আছে যা প্রায় সম্পূর্ণভাবে সরকারকেই করতে হয়, যেমন প্রাথমিক শিক্ষা। এই খাতে জনগণের নিজ উদ্যোগে বা টাকাপয়সা খরচ করে কিছু করার সুযোগ অল্প। কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় অবশ্যই স্থাপিত হচ্ছে এবং দানশীল ব্যক্তিরা নিজের স্বার্থে (যেমন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য) অথবা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য কিছু অর্থ ব্যয় করেন। তবে প্রাথমিক শিক্ষার ব্যয়ের সিংহভাগই আসে সরকারি বরাদ্দ থেকে, অর্থাৎ বাজেট থেকে। অন্যদিকে মাছ-মাংস, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদির জোগান হয় ব্যক্তিগত বা বাণিজ্যিক উদ্যোগ থেকে। পোলট্রি ফার্ম, মাছ ও গরু-ছাগলের খামার ছড়িয়ে আছে সারা দেশে। সবই ব্যক্তিমালিকানাধীন। সরকারের অবশ্যই একটা ভূমিকা আছে মাছ বা হাঁস-মুরগির রোগবালাই হলে নিরাময়ের ব্যবস্থা করা; বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে খামারিদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দেওয়া, উন্নততর প্রজননের ব্যবস্থা করা; নিয়ম করে জাটকা নিধন বন্ধ রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। মূল কথা, মত্স্য ও পশুতে ব্যক্তি ও বাণিজ্যিক উদ্যোগই মুখ্য, সরকারের ভূমিকা গৌণ। তাতেই আসছে অর্থবছরে বরাদ্দ ১ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা।

প্রাথমিক শিক্ষার মতো আইন ও বিচার পুরোপুরি সরকারনির্ভর, এই সেক্টরটা মত্স্য ও পশুর সেক্টরের মতো নয়। বাড়ির পাশে জায়গা ও টাকা থাকলে আপনি ইচ্ছা করলেই পোলট্রি ফার্ম বা মত্স্য খামার শুরু করতে পারেন, কিন্তু ইচ্ছা করলেই বাড়ির পাশে আদালত ও বিচারক বসানো যাবে না। সরকার সরকারি খরচেই সবকিছু প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করবে। কিন্তু দেশ আইন ও বিচারের জন্য কয় পয়সা বরাদ্দ রেখেছে? গত দু-তিন বছরে প্রতিবছর বেড়েছে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকা হারে। বৃদ্ধির এই হার কোনো হিসাবের মধ্যে ফেলা কঠিন। বরাদ্দ বাড়লে, বিচারপতি-বিচারক বাড়লে, প্রয়োজনীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়লে, অবকাঠামোগত সুবিধাদি বাড়লেই কেবল মামলা নিষ্পত্তির গতি বাড়বে, অন্যথায় যা হওয়ার তা–ই হচ্ছে, মামলার জট বাড়ছে। মামলার জটে দেশ সয়লাব।

মামলার জটে বাঁধা পড়া ভুক্তভোগীদের কষ্ট ঈদের রাস্তার যানজটে আটকে থাকা যাত্রীদের চেয়ে অনেক বেশি। ঈদের যাত্রী জানে, ছয়, আট বা চৌদ্দ ঘণ্টা পর হলেও বাড়িতে পৌঁছাবে। বেশির ভাগ যাত্রী ঈদে বাড়ি যায় স্বেচ্ছায়, সুখ ও আনন্দের খোঁজে, তাই পথে কিছুটা কষ্ট সে সইতে রাজি। কিন্তু শখ করে, খুশির চোটে মামলা করার মানুষের সংখ্যা আঙুলে গোনা যাবে। নাগরিক মামলা করে বাধ্য হয়ে, আর কোনো সমাধান না পেয়ে। তাই অপেক্ষা, ঘোরাঘুরি, দৌড়াদৌড়ি, উকিল-সাক্ষীর পেছনে ঘোরা, এই কেরানি, ওই কর্মচারীকে টুপাইস দেওয়া—সবটাই ভোগান্তি চরমে পৌঁছায়। এত কিছুর পরও বরাদ্দ না বেড়ে যদি কমে, তাহলে ভোগান্তিটা হবে অসহনীয়।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, শেখ আবদুল আজিজ, ড. কামাল হোসেন—এই নামগুলো আমাদের পরিচিত, পেশাগতভাবে তাঁরা সবাই ছিলেন অ্যাডভোকেট। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি শপথ নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর প্রথম মন্ত্রিসভার বঙ্গবন্ধুসহ মোট ১৩ জনের মধ্যে এই ৭ জনই ছিলেন আইনজীবী। এ ছাড়া ওই মন্ত্রিসভার আরেকজন সদস্য এ এইচ এম কামারুজ্জামানেরও আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি ছিল (দ্রষ্টব্য: এ এস এম সামছুল আরেফিন, বাংলাদেশের নির্বাচন ১৯৭০-২০০৮, বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন, ২০১১; পৃষ্ঠা ৫৩৭-৩৮)। বর্তমান মন্ত্রিসভার অবস্থা সমপূর্ণ ভিন্ন। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য যত্সামান্য বরাদ্দের সঙ্গে মন্ত্রীদের পেশাগত অবস্থানের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা পাঠকই বিবেচনা করবেন। আইন ও বিচারের জন্য এই অপ্রতুল বরাদ্দের কারণে মামলার জট তো বাড়বেই আর এটাকে কৈফিয়ত হিসেবে দাঁড় করিয়ে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা চলতে থাকবে।

আগামীকাল: আইন ও বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে শুধু কমে

ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক