রোজার কাজা ও কাফফারা

.
.

আল্লাহ মানুষের পরম বন্ধু। হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার মহান বন্ধু। মানুষ আল্লাহর ভালোবাসার টানে, আল্লাহর প্রেমের অনুরাগে তাঁর ইবাদত-বন্দেগি তথা আনুগত্য স্বীকার করে। আল্লাহ অনুগ্রহ করে বান্দার জন্য রমজান মাসের রোজা ফরজ করেছেন। বান্দা তা সাগ্রহে পালন করে। কোনো কারণে সময়মতো রোজা রাখতে না পারলে, তা কাজা আদায় করতে হয়। রোজা রেখে কোনো ওজর বা অসুবিধার কারণে ভেঙে ফেললে তাও পরে কাজা আদায় করতে হয়। কাজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে একটি রোজা। কিন্তু কখনো যদি রোজা রেখে কোনো ধরনের ধোঁকায় বা তাড়নায় বিপথগামী হয়ে বিনা ওজরে তা ভঙ্গ করে; তখন আল্লাহ অত্যন্ত নাখোশ হন। এর জন্য কাজা ও কাফফারা আদায় করতে হয়। কাজা হলো একটি রোজার পরিবর্তে একটি আর কাফফারা হলো একটি রোজার পরিবর্তে ৬০টি। এভাবে ওজর ছাড়া যে কয়টা রোজা রেখে ভাঙবে, প্রতিটির পরিবর্তে একটি করে রোজা কাজা এবং একই রমজান মাসের জন্য তার সঙ্গে যুক্ত হবে একটি কাফফারা। অর্থাৎ একটি রোজা যৌক্তিক কারণ ছাড়া ভাঙলে তার জন্য কাজা ও কাফফারা হবে ৬১টি রোজা।
কাফফারা আদায়ের উপায়

কাফফারা তিন উপায়ে আদায় করা যায়। প্রথমত, একটি গোলাম আজাদ করা বা দাসমুক্ত করা; দ্বিতীয়ত, বিরতিহীনভাবে ৬০টি রোজা পালন করা। কাফফারার রোজার মাঝে বিরতি হলে বা ভাঙলে আরেকটি কাফফারা ওয়াজিব হয়ে যাবে। তৃতীয় হলো ৬০ জন মিসকিনকে দুই বেলা ভালোভাবে আহার করানো বা আপ্যায়ন করা।

কাফফারা ও মানবতার অনন্য কাহিনি
বুখারি শরিফ ও মুসলিম শরিফে সহিহ রিওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে: একবার রমজানে এক ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.), আমি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলেছি, আমি রোজা পালন অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করে ফেলেছি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে বললেন, তুমি একজন দাসকে মুক্ত করে দাও। ওই ব্যক্তি বললেন, এমন সক্ষমতা আমার নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তবে এর বদলে দুই মাস (বা ৬০ দিন) রোজা রাখো। লোকটি বললেন, এমন শারীরিক সক্ষমতা আমার নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তবে তুমি ৬০ জন মিসকিনকে খাওয়াবে। লোকটি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! (সা.) এ রকম আর্থিক সক্ষমতাও তো আমার নেই। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে অপেক্ষা করতে বললেন। এর কিছুক্ষণ পর কোনো একজন সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে এক ঝুড়ি খেজুর উপহার দিলেন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) ওই লোকটিকে ডেকে বললেন, এগুলো নিয়ে গিয়ে গরিবদের মাঝে সদাকাহ করে দাও। লোকটি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) এ এলাকায় আমার মতো গরিব আর কে আছে? এ কথা শুনে রাসুলে করিম (সা.) স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি হাসলেন এবং বললেন, ‘আচ্ছা তবে খেজুরগুলো তুমিই তোমার পরিবার নিয়ে খাও।’ (বুখারি, হাদিস নম্বর: ১৩৩৭, মুসলিম, হাদিস নম্বর: ১১১১)।

ছোট শিশুদের রোজা ভেঙে ফেলা
ছোট্ট শিশুরা নিজেদের আগ্রহে ও বড়দের উৎসাহে রোজা রাখে। যদিও তাদের জন্য রোজা রাখা ফরজ নয়। এমতাবস্থায় তারা যদি রোজা রেখে কখনো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় যেকোনোভাবে রোজা ভেঙে ফেলে, তাহলে তাদের এই রোজার কাজা বা কাফফারা কোনোটিই লাগবে না। (হিদায়া)।

ইনহেলার ও সাপোজিটরি নেওয়া
রোজা অবস্থায় ইনহেলার ও সাপোজিটরি নেওয়ার বিষয়ে ফকিহদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ ফকিহর মতে, এতে রোজা ভঙ্গ হবে এবং কাজা আদায় করতে হবে। তবে কাফফারা লাগবে না। অনেক ফকিহর মতে, ব্যক্তি পানাহার ত্যাগ করে রোজা রাখতে সক্ষম হলে রোজা পালন করবে; যেহেতু ইনহেলার না নিয়ে থাকতে পারে না তাই ইনহেলার নেবে; আর ইনহেলার নেওয়ার কারণে রোজা ভঙ্গের আশঙ্কা থাকায় ফিদইয়াও দেবে, যাতে করে তার সব পথ খোলা থাকে। সাপোজিটরি যেহেতু খাদ্য নয়, খাদ্যের বিকল্পও নয় এবং তা পাকস্থলীতেও প্রবেশ করে না; তাই এর দ্বারা রোজা ভঙ্গ হবে না। তবু সতর্কতা হিসেবে কাজা আদায় করা উত্তম হবে। (আল ফিকহুল ইসলামি আদ দুওয়ালি)।

চোখে, নাকে ও কানে ড্রপ দেওয়া
রোজা অবস্থায় দিনের বেলায় প্রয়োজনে চোখে, নাকে ও কানে ড্রপ দেওয়া যায়। কারণ, এটি পানাহারের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং এর দ্বারা পানাহারের উদ্দেশ্যও সাধিত হয় না। সর্বোপরি এসব ওষুধ সরাসরি পাকস্থলী বা মস্তিষ্কেও যায় না। যদিও কখনো কখনো নাকে বা চোখে ড্রপ দিলে মুখে তার স্বাদ অনুভূত হয়; তবু এটি অতি স্বল্প মাত্রায় হওয়ার কারণে ধর্তব্যের আওতায় পড়ে না। যেমন: অজু করার সময় কুলি করলে মুখের ভেতরে পানি লাগে, তাতে কিন্তু রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। গোসল করার সময় শরীরের লোমকূপসমূহ দিয়ে অল্প পরিমাণে পানি প্রবেশ করে, তাতে যেমন রোজার ক্ষতি হয় না, তেমনি শরীরের যেকোনো জায়গায় ক্ষত বা ব্যথায় মলম, ক্রিম এবং পাউডার ও স্প্রে-জাতীয় ওষুধ লাগালেও রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। (মাজমাউল ফাতাওয়া)।
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।
[email protected]