উৎসবের ছুটিতে কেন ঝরে প্রাণ?

রোজার আগে থেকেই সব জিনিসের দাম বাড়তে থাকে। কিন্তু মন্ত্রীরা বলে দেন, রোজায় আর দাম বাড়বে না। কেউ বলেন, ১০ বছরেও বাড়েনি দাম। মানুষ হাসে। চড়া দামের ফাঁসে হাঁসফাঁস করতে করতেও তারা হাসে। সাত চড়ে রা করে না যে অসহায় মানুষেরা, তাদের সে হাসিকে কেউ যদি মনে করেন অনুমোদন, তাহলে গাধাকেই ওস্তাদ মানতে হয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ুক বা না বাড়ুক, মানুষের দাম যে দিনকে দিন কমছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মন্ত্রী আর পরিসংখ্যানবিদদের সন্দেহ আছে। তাঁরা তোতাপাখির মতো বলতে থাকেন, বেড়েছে, বাড়ছে। গড় আয়ু বাড়ছে। মানুষ আগের চেয়ে কম মরছে, বাঁচছে বেশি দিন। অসুখে-বিসুখে, বন্যা, সাইক্লোনে, ঝড়ে, বাজে মানুষ মারা গেলে সেটা তবু মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু মানুষ যখন উৎসবে-পার্বণে মরে, তখন তা কি কবুল করা যায়?

২০১৬ সালে দুই ঈদে ঝরে পড়ে ৪০১টি প্রাণ। ঈদুল ফিতরে ১৯০ আর ঈদুল আজহায় ২১১। তারা সবাই ঈদের আবহের মধ্যে খুশি উদ্‌যাপন করছিল। এসব মৃত্যুর সবটাই ঘটেছে প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনায়। গত বছর (২০১৭) দুই ঈদে প্রাণ হারায় ৫৬৪ জন মানুষ। ২৪ জুন সকালে একটা ট্রাক উল্টে রংপুরে একনিমেষে মারা যান ১৭ জন পোশাককর্মী। দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যার ১০ গুণ হয় আহত। সে সংখ্যা হাজারে হাজার। গড় আয়ুর বরকতে আহত ব্যক্তিরা হয়তো বাঁচবে আরও কিছুদিন। বেশির ভাগ প্রাণ ঝরে যায় নানা প্রতিরোধযোগ্য সড়ক দুর্ঘটনায়, তবে সব মৃত্যু সড়কে ঘটেনি। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে ঈদের ছুটিতে প্রায় ১১ জন মারা যায় পানিতে ডুবে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ পানিতে ডোবা। তাদের প্রায় ৪৭ শতাংশই মারা যায় ছুটির দিনগুলোতে। দুই ঈদের ছুটি তাদের জন্য বড় হুমকি নিয়ে আসে। গত বছর ঈদে সাত বছরের ফুটফুটে যমজ বোন জামালপুরের সরিষাবাড়ীতে নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা যায়। বছর কয়েক আগে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার গাঁওদিয়া গ্রামে ঈদের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে দুই খালাতো বোন পানিতে ডুবে মারা যায়। সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্র কাপাসিয়ায় ঈদের ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে শীতলক্ষ্যায় গোসল করার সময় ডুবে মারা যায় ।

পানিতে ডুবে মরার এমন ঘটনা অজস্র। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঈদের আরেক আতঙ্ক। মা-বাবার আদরের দুলালদের অনেকেই ঈদের দিন বন্ধুদের নিয়ে মোটরবাইকে ঘুরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা যায়। ঈদের দিনে হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত কিশোর-তরুণ রোগীর ভিড় বেড়ে যায়। গাইবান্ধার ২৩ বছরের তরুণ রুবেল ঈদের দিন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। ঈদের দিন সন্ধ্যায় চাচার বাড়ি থেকে দাওয়াত খেয়ে মোটরসাইকেলে ফেরার পথে মনির (২২) আর সামিউল (২২) নিহত হন, লালমনিরহাট সদরের বড়বাড়ি জুড়াবান্ধায়। তাঁরা দুজন দুটি মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন, সঙ্গে ছিলেন আরও চার সঙ্গী। একেকটা মোটরসাইকেলে তিনজন আরোহী। বলা বাহুল্য, কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুটি মোটরসাইকেল পাল্লা দিয়ে খুব দ্রুত ছুটছিল। একপর্যায়ে পরস্পরের সঙ্গে জোরে ধাক্কা খায়, দুই চালক রাস্তায়ই মারা যান। ঈদ বা ছুটির দিনে তরুণদের এ রকম বেপরোয়া হয়ে উঠতে প্রায়ই দেখা যায়। দুর্ঘটনার প্রধান মাশুল তাঁরাই দেন।

সব ঘটনা পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদনেও হিসাব আসে না। এলে জানা যেত। যেটুকু খবর আমরা পাই, পরিস্থিতি তার থেকেও ভয়াবহ এবং ক্রমশ তার অবনতি বৈ উন্নতি হচ্ছে না।

উপায় কী?

সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধের নানা উপায় বাতলে প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু লেখা হচ্ছে। দক্ষ চালক, খানাখন্দহীন সড়ক, সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদির পাশাপাশি চার লেন-উড়ালসড়কের সুপারিশ আসছে। কিন্তু শুধু অবকাঠামো গড়েই যে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা আমরা সদ্য নির্মিত চার লেন-উড়ালসড়ক দিয়ে টের পাচ্ছি। আমাদের বর্তমান সমস্যার সিংহভাগই কেবল ন্যায্য আর দক্ষ ব্যবস্থাপনা দিয়ে সমাধান সম্ভব। একটু সচেতন হলে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ছুটে যাওয়া পরিবারগুলো তাদের শিশুদের সুরক্ষা দিতে পারে। অনেক দিন পর বাড়ি গিয়ে আমরা যেন এমন আত্মহারা না হই, যাতে আমাদের শিশুরা অকালে হারিয়ে যায়।

ঈদ বা ছুটির দিনে যত আদরের পাত্রই হোক, তার যদি মোটরসাইকেল চালানোর লাইসেন্স না থাকে, হেলমেট না থাকে, আর নিয়ম মেনে চালানোর ফুরসত না মিলে, তাহলে কেন আমি তার হাতে সাইকেলের চাবিটা তুলে দেব? তাকে যমের ঠিকানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করব?

আমাদেরই সাবধান হতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক