কিম বংশের রাজত্ব পোক্ত করে দিলেন ট্রাম্প!

কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প
কিম জং-উন ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে যে সমঝোতায় সই করলেন, সেটি কেমন হয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখার একটি মোক্ষম কায়দা আছে। কায়দাটা হলো, ট্রাম্প গদগদ হয়ে উত্তর কোরিয়ার একনায়কের সঙ্গে করমর্দন করে যা যা বললেন, সেই একই কাজ যদি বারাক ওবামা করতেন, তাহলে তার প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প কী বলতেন, তা কল্পনা করে দেখতে হবে।

কল্পনায় ট্রাম্পের জায়গায় ওবামাকে বসালে দেখা যেত, ট্রাম্প ও ফক্স নিউজে থাকা তাঁর চামচারা কিমের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য ওবামার মাথায় বালতি বালতি তাচ্ছিল্যের আবর্জনা ঢেলে দিচ্ছেন। নিষ্ঠুর স্বৈরাচারীর প্রশংসা করা এবং তাঁকে বিশ্বসভায় এমনভাবে মহিমান্বিত করার জন্য ওবামাকে তাঁরা সমালোচনার তিরে ঝাঁঝরা করে ফেলছেন। এই কাজ যদি ওবামা করতেন তাহলে দেখা যেত, ট্রাম্প এই সমঝোতা চুক্তিকে ‘ভয়ানক জিনিস’ বলে প্রচার করতেন এবং এতে সই করার জন্য ওবামাকে ‘শোষক’ আখ্যা দিতে তাঁর বাধত না।

প্রথমেই খেয়াল করুন, এই বৈঠক ও সমঝোতা থেকে কিম কতটুকু পেলেন। একসময় যাকে সমাজচ্যুত ও অস্পৃশ্য বলে মনে করা হতো, সেই কিম এই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সমমর্যাদা পেলেন। দুজনেরই অভিন্ন শর্তের মর্যাদা ছিল। তাঁরা যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাত মেলাচ্ছিলেন, তখন উভয়ের পাশে সমানসংখ্যক পতাকা ছিল। এখন এই স্বৈরাচারের হাতে সিঙ্গাপুরে ভাষণ দেওয়া ও ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করাসহ বহু ভিডিও চিত্র আছে। সিঙ্গাপুরে বহু লোক তাঁকে ঘিরে ছিল এবং অনেকে তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলেছেন। বিবিসি এই দৃশ্য প্রচার করেছে এবং এসব লোককে কিমের ‘ভক্ত’ বলেও উল্লেখ করেছে। এসব ভিডিও চিত্র দিয়ে বছরব্যাপী না হলেও কয়েক মাস ধরে অনায়াসে কিম তাঁর প্রপাগান্ডা চালাতে পারবেন।

এসবের বাইরে আরও বড় বিষয় হলো, সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প কিমের যে প্রশংসা করেছেন, তা নজিরবিহীন। তিনি কিমের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘কিম অত্যন্ত মেধাবী লোক। তিনি তাঁর দেশকে ভীষণ ভালোবাসেন।’ কিম এত সৌভাগ্যবান যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে ‘উত্তর কোরিয়ার মতো একটি দেশ চালানোর মতো কঠিন কাজ’ করার জন্য অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। এমনকি কিম যেসব অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছেন, তার কোনো উল্লেখই ট্রাম্প করেননি। যখন ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মানবাধিকার নিয়ে কোনো কথা হয়েছে কি না; তখন তিনি বলেছেন, ‘সংক্ষিপ্ত আলোচনা’ হয়েছে।

 কিম জং-উনের বংশ কয়েক দশক ধরে পারিবারিক স্বৈরতন্ত্রের যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কামনা করে এসেছে, তার অনেকটাই কিম সঙ্গে করে নিয়ে দেশে ফিরেছেন। কিন্তু কিমকে ট্রাম্পের উপহার দেওয়া এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। তিনি কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়া বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই মহড়াকে তিনি শুধু ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ বলেই উল্লেখ করেননি; এটিকে উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন থেকে ‘উসকানিমূলক’ বলে যেভাবে উল্লেখ করে, ঠিক একইভাবে ট্রাম্পও উসকানিমূলক শব্দটি একইভাবে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সেখানে নিয়োজিত ২৮ হাজার মার্কিন সেনাকে আস্তে আস্তে সরিয়ে আনা হবে বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।

এখন দেখা যাক, এত কিছুর বিনিময়ে কিম ট্রাম্পকে কী কী উপহার দিয়েছেন? কিমের কাছে ট্রাম্পের প্রথম এবং প্রধান চাওয়া ছিল ‘পরিপূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ’। কিম সেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটি যেমন-তেমন প্রতিশ্রুতি নয়। এর আওতায় উত্তর কোরিয়াকে তাঁর সমস্ত পরমাণু কার্যক্রম স্থায়ীভাবে লুপ্ত করতে হবে। সেই দিক থেকে বিবেচনা করলে কিমের কাছ থেকে এত বড় প্রতিশ্রুতি আদায় করার জন্য ট্রাম্পকে অবশ্যই অভিনন্দন জানাতে হয়। কিন্তু তার আগে সমঝোতা চুক্তির ওই ছোট্ট টেক্সটের দিকে আসুন একটু নজর বোলানো যাক।

 সমঝোতায় বলা হচ্ছে, ‘কোরীয় উপদ্বীপকে পরিপূর্ণভাবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কাজ এগিয়ে নিতে উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।’ খেয়াল করুন, কিম ‘পরিপূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের’ প্রতিশ্রুতি দেননি; তিনি কেবল ‘পরিপূর্ণভাবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের কাজ এগিয়ে নেওয়ার’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সারা দুনিয়ার সমঝোতাকারী কূটনীতিকেরাই জানেন, প্রতিশ্রুতিতে ফাঁক থাকলে চুক্তির ভাষায়ও ফাঁক থেকে যায়। আসলে কিম শুধু আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা শুনিয়েছেন। তিনি কোনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ কিংবা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও দেননি।

যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নিই, কিম পরিপূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন; তাহলেও দেখা যাবে যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া অনুযায়ী উত্তর কোরিয়া এই কার্যক্রম বন্ধ করবে না। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল, এই পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ হবে ‘কমপ্লিট, ভেরিফাইয়্যাবল অ্যান্ড ইররিভারসিবল ডিসম্যান্টেলমেন্ট’ (সম্পূর্ণ, যাচাইযোগ্য এবং পুনর্নির্মাণ অযোগ্য বিলোপ সাধন), সংক্ষেপে ‘সিভিআইডি’। কিন্তু সমঝোতাপত্রে কৌশলে ‘ভেরিফাইয়্যাবল’ (যাচাইযোগ্য) এবং ‘ইররিভারসিবল’ (পুনর্নির্মাণ অযোগ্য) শব্দ দুটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। চিন্তা করুন, ১১০ পৃষ্ঠার ইরান চুক্তিতে পরমাণু অস্ত্র পরিদর্শক রাখা, নজরদারি ক্যামেরা বসানোসহ অজস্র শর্ত থাকার পরও এটিকে ট্রাম্প ‘ভয়ানক চুক্তি’ বলে সেটি থেকে বেরিয়ে এসেছেন। অথচ সেই ট্রাম্পই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে যে সমঝোতায় সই করলেন, সেটি মাত্র দেড় পৃষ্ঠার। সেখানে ‘যাচাইযোগ্য’ কথাটিও অন্তর্ভুক্ত নেই।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, গত এপ্রিলে দুই কোরিয়ার বৈঠকের পর যে পানমুনজম ঘোষণা প্রকাশ করা হয়, এই সমঝোতা সেই ঘোষণারই প্রতিফলন। পানমুনজম ঘোষণায় পিয়ংইয়ং বলেছে, তারা কোরীয় উপদ্বীপের পরিপূর্ণ পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ কার্যক্রমকে বৈশ্বিক পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের অংশ হিসেবে দেখতে চায়। এ কথার মানে দাঁড়ায়, রাশিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা পরমাণু অস্ত্র ত্যাগ করলেই উত্তর কোরিয়া তার কার্যক্রম বন্ধ করবে।

ট্রাম্প এই সমঝোতায় সই করার পর নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, তাঁর পূর্বসূরিরা যা পারেননি, তিনি তা–ই করে দেখালেন। তবে সিউলভিত্তিক বিশ্লেষক আন্দ্রেই লানকভ বলেছেন, এই সমঝোতা থেকে যা কিছু অর্জন হয়েছে তা উত্তর কোরিয়ারই হয়েছে; যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি।

তবে তারপরও কিম ও ট্রাম্প হাত মিলিয়েছেন। এতে আঞ্চলিক পরমাণু যুদ্ধের হুমকি কমে এসেছে। এ জন্য আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। তবে আফসোসের কথা হলো, এর মাধ্যমে কিম বংশকে এমনভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো যে, তারা আরও নির্বিঘ্নে উত্তর কোরিয়ায় তাদের দুঃশাসন আরও বহুদিন চালিয়ে যাওয়ার আন্তর্জাতিক অনুমোদন পেল।

দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

োনাথন ফ্রিডম্যান দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক