রিজার্ভ ভেঙে 'মুরগির খাবার'!

আকা : তুলি
আকা : তুলি

নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু হবে, সেটা সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অনেক দিন ধরেই শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, আর অর্থমন্ত্রী সেদিনও পরিষ্কার করে বললেন যে নিজেদের সম্পদেই পদ্মা সেতু হবে এবং এ প্রকল্পে অর্থের জোগান দিতে কোনো সমস্যাই হবে না। যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি, জাতীয় বাজেট হয় দুই লাখ কোটি টাকার ওপরে, সেখানে পদ্মা সেতুর খরচ অর্থমন্ত্রীর কাছে অনেকটা ‘মুরগির খবারের’ মতো। (ডেইলি স্টার, ৩ ফেব্রুয়ারি) কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই ‘মুরগির খাবার’তুল্য খরচটি করতে হবে মূলত বৈদেশিক মুদ্রায়। ফলে বারবার অর্থমন্ত্রীকে এর ব্যাখ্যা দিতে হচ্ছে। আর পত্র-পত্রিকাগুলোও নাকি বারবার ভুল করছে, অর্থমন্ত্রীর কথার ভুল অর্থ করছে!
গত সোমবার অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে আমাদের সবার ভুল ভাঙানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দিয়ে পদ্মা সেতু নির্মিত হবে বলে বলা হচ্ছে, ব্যাপারটি সে রকম নয়। পত্রিকায় ভুলভাবে প্রতিবেদন করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ১৮.৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ‘আমি বলেছি, এই রিজার্ভ থেকে পদ্মা সেতুর জন্য ২০২ কোটি ডলার ব্যয় করতে হতে পারে।’ সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্য থেকে যা পরিষ্কার হলো তা হচ্ছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাজেটে অর্থ বরাদ্দ থাকবে বছর বছর, আর সেই অর্থ ডলারে রূপান্তর করা হবে। কিন্তু প্রশ্নটি হচ্ছে, বাজেটে বরাদ্দ করা অর্থ ডলারে রূপান্তর করা হবে কীভাবে?
অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়ে পদ্মা সেতুর খরচ প্রক্রিয়ার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। তিনি জানালেন, পদ্মা সেতুর জন্য অগ্রণী ব্যাংকে একটি হিসাব খোলা আছে। ওই হিসাবে জমা হওয়া টাকাকেই ডলারে রূপান্তর করবে অগ্রণী ব্যাংক। ডলার কম পড়লে অগ্রণী ব্যাংক তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য চাইবে।
কথা তো সেই একই দাঁড়াল! পদ্মা সেতুর ডলারের জন্য তো শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভেই হাত দিতে হবে। ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমইএ) পক্ষ থেকে কারখানার যন্ত্রাংশ আমদানিতে অর্থমন্ত্রীর সহায়তা চাওয়া হয়েছিল। তখন অর্থমন্ত্রী অপারগতা প্রকাশ করে বলেছেন, পদ্মা সেতুর কার্যাদেশ দেওয়ার সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা লাগবে। তাই এ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে পারবে না।
শুরুতে যে পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রক্কলিত ব্যয় ছিল ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো, তা এখন প্রায় ২৫ হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকতে যাচ্ছে। আর এই খরচের প্রায় ৮০ শতাংশই ব্যয় করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। এখন অর্থমন্ত্রী যাই বলুন, পুরো প্রকল্পই যদি নিজেদের সম্পদে করতে হয়, তবে এই বৈদেশিক মুদ্রার জন্য রিজার্ভে হাত না দিয়ে আর উপায় কী!
পদ্মা সেতুর মতো এত বড় অবকাঠামো নির্মাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত দেওয়া আসলে কতটা যৌক্তিক? এ ধরনের উল্লেখযোগ্য কোনো উদাহরণ কি বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আছে? অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের বিষয়টি ভারতসহ বিশ্বের নানা দেশে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাব ও উদ্যোগ ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাস্তবসম্মত নয় বলে কার্যকর হয়নি।
স্ট্যানফোর্ড সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের উদ্যোগে ২০০৫ সালে একটি গবেষণাপত্র বের হয়েছিল অবকাঠামো নির্মাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার নিয়ে। চরণ সিংয়ের লেখা ওই গবেষণাপত্রে শিরোনাম ছিল ‘Should India use Foreign Exchange Reserve for Financing Infrastructure?’ (সেপ্টেম্বর, ২০০৫)। সে সময় ভারতে অবকাঠামো নির্মাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছিল। তখন ভারতের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৪০ বিলিয়ন ডলারের মতো। ভারত সরকার তখন চাইছিল বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের কিছু অংশ অবকাঠামো তৈরির কাজে ব্যবহার করতে। রিজার্ভ ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক প্রশ্নে চরণ সিং তাঁর গবেষণাপত্রে লিখেছেন, ‘অবকাঠামো নির্মাণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহারের নজির বিশ্বে অন্য কোনো দেশে নেই। এ অঞ্চলের বেশ কিছু দেশের তুলনায় ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কম এবং সেই বিবেচনায় এটা বলা যায় যে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা প্রত্যাশিত সাফল্যের তুলনায় অর্থনৈতিক জটিলতা তৈরি করতে পারে।’
চরণ সিং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখার গুরুত্ব প্রসঙ্গে ‘ইস্ট এশিয়ান ক্রাইসিসের’ উদাহরণ টেনেছেন। ১৯৯৭ সালের এই সংকটের সূচনা ঘটিয়েছিল বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। তখন থাই সরকার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতির কারণে থাই বাথের নির্দিষ্ট বিনিময়মূল্য ধরে রাখতে পারেনি এবং বাথকে ভাসমান করে দিতে বাধ্য হয়। থাইল্যান্ডের এই সংকট দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সংকটের পর উন্নয়নশীল দেশগুলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং তা ধরে রাখার নীতি গ্রহণ করে। এটা শুধু চলতি হিসাব বা খরচের ঘাটতি দূর করার জন্য নয়, বরং যেকোনো ঝুঁকি ও পরিস্থিতি মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জনের জন্য। বাংলাদেশ বা এ ধরনের যেকোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা এবং বিশ্ব অর্থনীতি ও বাজারের যেকোনো অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি এড়াতে একটি উল্লেখযোগ্য রিজার্ভ ধরে রাখার বিষয়টি খুবই জরুরি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে সেই অর্থ ব্যয় কতটা বাস্তবসম্মত, তা জানতে চেয়েছিলাম সাবেক সচিব ও ‘ফিন্যান্সিং লার্জ প্রজেক্টস’ গ্রন্থের সহরচয়িতা এম ফাওজুল কবির খানের কাছে। তিনি বললেন, ‘রিজার্ভের মূল ব্যবহার হচ্ছে আমদানি ব্যয় মেটানো এবং বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ রেটের স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। রিজার্ভ একটি সাময়িক ও নিয়মিত খরচের বিষয়। নানা কারণে এটা বাড়ে ও কমে। সম্পদ হিসেবে এটা স্বল্পমেয়াদি। এই স্বল্পমেয়াদি সম্পদ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ করার কোনো সুযোগ নেই। পদ্মা সেতু একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ। ফলে রিজার্ভ ভেঙে পদ্মা সেতু বানানোর চিন্তাটি অনেকটা একজন মাঝারি চাকুরের মাসের খরচের টাকা দিয়ে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন দেখার মতো বিষয়। ব্যাংক বা হাউস ফিন্যান্সিংয়ের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া ছাড়া শুধু মাসের বেতনের টাকায় কি কেউ সাধারণ ফ্ল্যাট কেনার কথা ভাবতে পারেন?’
পদ্মা সেতু একটি দীর্ঘমেয়াদি সম্পদ। এখানে যে বিনিয়োগ হবে, তা খরচ করতে হবে বছর তিনেকের মধ্যে, আর ফেরত আসতে সময় লেগে যাবে ৩০-৪০ বছর। এত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বছরের খরচ বা আয়ের টাকা বাঁচিয়ে বানানোর ধারণাকে অবাস্তব হিসেবেই মানতে হচ্ছে। চীন (রিজার্ভ ৪২১৯ বিলিয়ন ডলার), তাইওয়ান (রিজার্ভ ৪২১ বিলিয়ন ডলার) বা সিঙ্গাপুরের (রিজার্ভ ২৭৩ বিলিয়ন ডলার) মতো দেশও অবকাঠামো তৈরির কাজে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ খরচ করে না।
আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মূল উত্স প্রবাসীদের আয়। সে ক্ষেত্রে এখন বড় ধরনের টান পড়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে প্রবাসী আয় কমেছে সাত হাজার ৬০৭ কোটি টাকা, আর জনশক্তি রপ্তানি কমেছে দুই লাখ (প্রথম আলো, ২৩ জানুয়ারি)। আমিরাতে বাংলাদেশি শ্রমিক নিয়োগ এখন বন্ধ রয়েছে। ১৮ বিলিয়ন ডলারের বর্তমান যে রিজার্ভ, তা সন্তোষজনক বটে, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে যে শুধু পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য আমদানির জন্যই বছরে বাংলাদেশকে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়। বিশ্ব পরিস্থিতির যেকোনো আকস্মিক পরিবর্তনে এই খরচ হুট করেই বেড়ে যেতে পারে। এখনকার এই স্থিতিশীল রিজার্ভের মূল কারণ আমদানি কমে যাওয়া। সামনে আমদানি বেড়ে গেলে এই রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে। যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি রক্ষাকবচের মতো।
বাংলাদেশ কেন, বিশ্বের যেকোনো দেশেই তিন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প একটি বড় প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। চার হাজার বিলিয়নের বেশি ডলারের মজুত নিয়েও চীনের মতো দেশ অবকাঠামো নির্মাণে ঋণ নেয়, রিজার্ভের অর্থে হাত দেয় না। আর ১৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের জোরেই পদ্মা সেতুর অর্থ আমাদের কাছে ‘মুরগির খাবার’ মনে হয়!
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
[email protected]