জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অবহেলা নয়

সম্প্রতি প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছে যে দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর ঘাটতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ফলে প্রায় ১২ শতাংশ ইচ্ছুক জনগোষ্ঠী এসব সামগ্রী ব্যবহার করতে পারছে না। পত্রিকাটি এই সমস্যার ওপর একটি সম্পাদকীয়ও প্রকাশ করেছে। আমি এই খবর এবং সম্পাদকীয়র সঙ্গে একমত হয়ে বলতে চাই, বর্তমান সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণকে যথাযথ অগ্রাধিকার দিচ্ছে না।

বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। বৃহৎ জনসংখ্যার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ, এক বর্গকিলোমিটারে প্রায় ১ হাজার ১২০ জন মানুষের বাস এ দেশে। জনসংখ্যার এই মাত্রাতিরিক্ত ঘনত্বের জন্যই বিশ শতকের সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে ওয়াকিবহাল মহলে ব্যাপক উদ্বেগ পরিলক্ষিত হতো। জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিলেন, জনসংখ্যাই বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’। আমরা জিয়াউর রহমানের এহেন নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে কখনোই সমর্থন করিনি। কারণ, বাংলাদেশের প্রকৃত এক নম্বর সমস্যা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। কিন্তু এর মানে তো এটা হতে পারে না যে আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা মানানসই আকারের (অপটিমাম সাইজ) থেকে বেশি, তা স্বীকারই করা যাবে না।

আমার মতে, বিদেশে বাংলাদেশিদের অভিবাসন প্রবাহ জনসংখ্যার সঠিক চিত্র পেতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মনে রাখতে হবে, চারটি পরিমাপের যোগ-বিয়োগের মাধ্যমে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার হিসাব করা হয়: জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার = (মোট জন্মহার – মোট মৃত্যুহার) + (বিদেশ থেকে দেশে বছরে অভিবাসন—দেশ থেকে বিদেশে বছরে অভিবাসন)। এই পরিমাপে সরকারগুলোর রাজনৈতিক বিবেচনা ভূমিকা পালন করছে বলে সন্দেহ করার কারণ আছে। ১৯৪৭ সালের পর ৭১ বছর ধরে এ দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠীর হার ২২ শতাংশ থেকে কমতে কমতে এখন জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশের কাছাকাছি এসে গেছে। আরেকটি বিষয় হলো, যদিও সরকারিভাবে বলা হয় যে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বাংলাদেশি প্রবাসে
অবস্থান করছেন, প্রকৃত সংখ্যাটা আসলে আরও প্রায় ৩০ লাখ বেশি হবে বলে এ বিষয়ের গবেষকদের ধারণা। এ দুই অভিবাসন প্রবাহের ফলে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার যত হওয়ার কথা ছিল, তার চেয়ে কম হচ্ছে।

এসব কথা বলার মূল উদ্দেশ্য হলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে যথাযোগ্য অগ্রাধিকার না দেওয়া সমীচীন হচ্ছে না। আমি গণচীনের ‘এক সন্তান নীতি’র মতো জবরদস্তিমূলক নীতি সমর্থন করি না, কিন্তু বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ‘ছেলে হোক বা মেয়ে হোক এক দম্পতির দুই সন্তানের বেশি নয়’ ধরনের প্রণোদনামূলক কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না কেন, তা আমি বুঝতে পারি না। শেখ হাসিনা সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০৯ সাল থেকে যেভাবে জনসংখ্যা পরিকল্পনা কার্যক্রম অনেকখানি গুটিয়ে ফেলা হয়েছে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রীর সংকট এহেন নীতিরই ফসল।

জবরদস্তির পথে না গিয়েও যে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব, তা প্রমাণ করেছে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতের কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গ। মানুষকে সুশিক্ষিত ও সচেতন করতে পারলে, স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা হলে, শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে পারলে, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা গেলে এবং জন্মনিরোধ পদ্ধতিগুলো মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করলে জনগণ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পরিবার পরিকল্পনায় উদ্বুদ্ধ হয়। এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে বিভিন্ন দেশে। বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন তত্ত্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে (আর্লি এক্সপান্ডিং ফেজ) প্রবেশ করেছিল। ওই পর্যায়ে জনসংখ্যা প্রায় ২.৫ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে। ফলে ১৯৪৭ সাল থেকে ২৫ বছরের কম সময়েই সত্তর দশকে এ দেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশন তত্ত্বে চারটি পর্যায় যে সব দেশকেই পেরোতে হবে, সেটা তথ্য-উপাত্তসহকারে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ার পর জনসংখ্যা তাত্ত্বিকদের মনোযোগ এখন নিবদ্ধ হয়েছে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের দ্বিতীয় পর্যায় কীভাবে সংক্ষিপ্ত করে বিভিন্ন জনবহুল দেশ যথাসম্ভব দ্রুত তৃতীয় পর্যায়ের ‘লেট এক্সপান্ডিং ফেজ’-এ প্রবেশ করতে পারে সে প্রয়াস জোরদার করায়। তৃতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে মোট জন্মহার ও মোট মৃত্যুহার উভয়ই দ্রুত কমে যায়। এই দুটো হারের পার্থক্য কমানোর মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দ্রুত কমিয়ে আনায় সাফল্য অর্জন করতে পারলে জনসংখ্যা নিয়ে উদ্বেগের কারণ থাকবে না। ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের চতুর্থ স্তরে প্রবেশ করার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোনো দেশের জন্য আর মারাত্মক সমস্যা থাকে না, বরং তখন সমস্যাটার রূপ বদলে যায়।

আশির দশকেই বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ট্রানজিশনের তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। অবশ্য বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখন ১.৩ শতাংশে নেমে গেছে বলে সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘের জনসংখ্যা-সম্পর্কিত সংস্থা ইউএনএফপিএর জরিপ মোতাবেক তা এখনো ১.৪২ শতাংশে রয়ে গেছে। এ দেশে মোট প্রজনন হার সত্তর দশকে ছিল ৬। এই হার কমে এখন ২.৩-এ দাঁড়িয়েছে, যা একটা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটাকে ২-এর অনেক নিচে নামাতেই হবে, যদি আমরা জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে নামাতে চাই। এর অন্যথা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির মোমেন্টামের ফলে ২০৩০ সালের পরও এ দেশের জনসংখ্যা বাড়তেই থাকবে। (পপুলেশন মোমেন্টাম বজায় থাকার মূল কারণ, শিশুদের সম্ভাব্য পিতা-মাতারা ৩০, ৪০, ৫০ বছর আগেই জন্ম নিয়েছেন।) এই হার না কমার গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাল্যবিবাহ। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে প্রায় সবার ওপরে।

অথচ বাল্যবিবাহ-সংক্রান্ত আইনে ধারা যুক্ত করা হয়েছে যে পিতা-মাতা সিদ্ধান্ত নিলে আদালতের অনুমতি নিয়ে কন্যাকে ১৬ বছরেও বিয়ে দিতে পারবেন। সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নারীর ন্যূনতম বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে বিশেষ ক্ষেত্রে ১৬ করার প্রবল তাগিদ কেন অনুভব করেছে, বুঝতে পারছি না। জনমিতি বা ডেমোগ্রাফি আমার উচ্চতর শিক্ষার বিশেষায়নের বিষয় এবং গবেষণার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। বিষয়টির অভিঘাত জনগণের জন্য ভবিষ্যতে অত্যন্ত নেতিবাচক হবে, সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ। বলতে গেলে, এই আইন একবারেই অবিমৃষ্যকারী। আমি মনে করি, অত্যন্ত বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে এ ব্যাপারটায়। ১৮ বছরেই থাকুক আইনগতভাবে নারীর বিয়ের ন্যূনতম বয়স। কোনো বিশেষ ব্যবস্থার সুযোগ আইনে রাখবেন না, রাখলে সমাজের ধর্মান্ধ গোষ্ঠী এবং নিম্নবিত্ত কৃষক-শ্রমিক পিতা-মাতার জন্য ওই বিশেষ ব্যবস্থাই ‘আইনি নিয়মে’ পর্যবসিত হবে।

বর্তমান বিশ্বে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কমবেশি সফলতা অর্জনকারী উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর বিপরীতে নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তেমন একটা কমাতে সক্ষম না হওয়ায় এই দুটো দেশের জনসংখ্যা বেড়ে বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে ইতিমধ্যেই ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশকে হটিয়ে নাইজেরিয়া এখন বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ।

আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার ১.৩ শতাংশ কিংবা ১.৪২ শতাংশ যা-ই হোক, সেটা নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগার অবকাশ নেই। দেশের জনসংখ্যার মোট প্রজনন হার আগামী ১০ বছরের মধ্যেই ২ শতাংশের অনেক নিচে নিয়ে আসতে হলে (মানে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হারকে ১ শতাংশের নিচে নামাতে হলে) ‘ছেলে হোক বা মেয়ে হোক এক দম্পতির দুই সন্তানের বেশি নয়’ নীতিকে আমাদের জনসংখ্যা নীতির সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের জায়গাটিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতেই হবে।

ড. মইনুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ইউজিসি অধ্যাপক