যা ভাবি তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি না

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
>ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ২৩ জুন বিক্রমপুরে। তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১০০। তিনি ১৬ বছর ধরে নতুন দিগন্ত নামে একটি সাময়িকী সম্পাদনা করে আসছেন। সমাজ রূপান্তরকামী এই লেখক-শিক্ষাবিদের ৮৩তম জন্মদিন উপলক্ষে প্রথম আলো সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করে, যাতে তিনিবাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামো, গণতন্ত্র, নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেছেন।


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান 

প্রথম আলো: আপনার ৮৩তম জন্মদিনে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আপনার জন্ম ঔপনিবেশিক ভারতে; যখন বেড়ে উঠেছেন, তখন এই ভূখণ্ড ছিল পাকিস্তান এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশ পেয়েছি। কিন্তু সমাজকাঠামোয় মৌলিক কোনো পরিবর্তন দেখেছেন কি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শুভেচ্ছার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। গত আট দশকে পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে, উন্নতিও দৃশ্যমান। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তন বলতে যদি বুঝি সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোতে পরিবর্তন, সেটা ঘটেনি। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রের যে আইনি কাঠামো ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু ছিল, সেটা পাকিস্তানের শাসনামলে বদলায়নি, বাংলাদেশেও অক্ষুণ্ন রয়ে গেছে। সম্পত্তির মালিকানা তখনো ব্যক্তিগত ছিল, এখনো তা-ই আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতিতে সমাজ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি ছিল; কিন্তু কার্যকর হয়নি। প্রশাসন রয়ে গেছে আগের মতোই আমলাতান্ত্রিক। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এখন এমনকি বামপন্থীদেরও অনেকে বলেন না। সমাজতন্ত্র এখন আশাবাদী মানুষদের স্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

উন্নতি যা ঘটেছে, সেটা পুঁজিবাদী রাস্তায়। পুঁজিবাদী তৎপরতা ব্রিটিশ আমলেও ছিল, পাকিস্তান আমলে তার চলার পথটি প্রশস্ত হচ্ছিল, বাংলাদেশে পথ আরও অবাধ হয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়াদের একাংশ রাষ্ট্রশাসনের ÿক্ষমতা পেয়েছে, তারা সংস্কৃতিতে না হলেও বিত্ত–বেসাতে বুর্জোয়া হয়ে গেছে। এতে কিন্তু সামাজিক সম্পর্কের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; ধনী-দরিদ্র সম্পর্কটা বরং আরও নিপীড়নমূলক হয়েছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে, কিন্তু তিন ধারার শিক্ষা প্রতিনিয়তই তাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং তিন ধারার শ্রেণিগত বিভাজন ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। এটা কিন্তু ভয়ংকর ব্যাপার। আপে‌ক্ষিক অর্থে যা-ই বলি না কেন, মৌলিক আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, এমনটা বলার উপায় নেই।

প্রথম আলো: আপনি সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে কাজ করছেন। কিন্তু সমাজটা আরও পিছিয়ে যাচ্ছে। এর কারণ হয়তো বলবেন, পুঁজিবাদ। সেটা তো আগেও ছিল?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, পুঁজিবাদ আগেও ছিল। কিন্তু পুঁজিবাদ এখন তার প্রগতিশীলতা খুইয়ে নিকৃষ্টতম পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এখন শিক্ষা, চিকিৎসা, বিচার, এমনকি খাওয়ার পানিও ক্রয়-বিক্রয়ের পণ্যে পরিণত হয়েছে। সর্বত্র মুনাফার রাজত্ব। ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া অন্য স্বার্থ বিবেচনায় আসে না। দেশপ্রেম নিম্নগামী। ভোগবাদিতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির বিচ্ছিন্নতা আগে এমন নিম্নপর্যায়ে পৌঁছায়নি। মাদকাসক্তির এমন বিস্তারও আগে কেউ কখনো দেখেনি। ধর্ষণ, খুন, গুম, পারিবারিক সহিংসতা—এসব প্রতিনিয়ত মানুষের নিরাপত্তা হরণ করছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির পরিসংখ্যানগত প্রমাণ আছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে তার সমর্থন নেই। উন্নতি দাঁড়িয়ে আছে দেশের ভেতরে ও বিদেশে আমাদের মেহনতি ভাইবোনদের শ্রমের ওপর ভর করে।

জ্ঞানের চর্চা কমে আসছে। কারণ, তার বাজারদর কমে গেছে। সামাজিক মিলনের পরিসর সংকুচিত হয়ে আসছে! সাংস্কৃতিক সৃষ্টিশীলতা ম্রিয়মাণ। বুর্জোয়াদের প্রশংসিত বিশেষ গুণ হচ্ছে সহনশীলতা, তার অভাব সর্বত্র। সংসদীয় গণতন্ত্র অকার্যকর। উন্নতির ফ্লাইওভারের নিচে পথচারীদের এই দুঃসহ যন্ত্রণাকে ব্যাখ্যা পুঁজিবাদকে অভিযুক্ত না করে কীভাবে করা সম্ভব, বলুন?

প্রথম আলো: শিক্ষক, লেখক, সম্পাদক—এ তিনটিই আপনার মুখ্য পরিচয়। এর মধ্যে একটি বেছে নিতে বললে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: লেখক পরিচয়কেই বেছে নেব। আমার দায় ছিল লেখক হওয়ার।

প্রথম আলো: সমাজবাদী রাজনৈতিক দর্শনে আপনি কবে থেকে আগ্রহী হলেন? আপনার প্রথম দিকের লেখায় সমাজবাদের কথা নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কথাটা ঠিক, আমার প্রথম জীবনের লেখায় সমাজতন্ত্রের কথা নেই। প্রথম জীবনে সাহিত্য আমি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাঠ করেছি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শিক্ষকেরা বলতেন, সাহিত্যপাঠে ভ্রমণটাই প্রধান, গন্তব্য নয়। পরে বুঝেছি, গন্তব্য না থাকলে আশঙ্কা থাকে ভ্রমণটা বিনোদনে পরিণত হবে। আমার ভেতর নতুন ওই বোধটা তৈরি হয় যখন আমি নন্দনতাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক বিচারের বৃত্তের বাইরে যেতে সক্ষম হই। এটা ঘটে ১৯৫৯ সালে, ওই সাহিত্যপাঠের জন্যই যখন আমি লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সে সময়ে ইউরোপজুড়ে তুমুল মতাদর্শিক বিতর্ক চলছিল। মতাদর্শ যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় ব্যাপার, সেই সচেতনতাটা তখনই আসে। আর মতাদর্শ যে তৈরি হয় অর্থনীতির দ্বারা, সেটাও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই।

প্রথম আলো: আপনার সম্পাদিত নতুন দিগন্ত কতটা তরুণদের মন জাগাতে পেরেছে? না পারলে ১৬ বছরের সাধনা কি ব্যর্থ বলে মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: নতুন দিগন্ত পত্রিকা এখন ১৬ বছর পার হয়ে ১৭ বছরে পা দিতে চলেছে। এটি সাহিত্য-সংস্কৃতির পত্রিকা। চলছে সামাজিক উদ্যোগে এবং অত্যন্ত বিরূপ পরিবেশে। তরুণদের ওপর বড় রকমের প্রভাব পড়েছে, এটা বলা যাবে না। তবে তাদের আগ্রহ বেড়েছে। না হলে এর প্রকাশনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো না। এত দিন ধরে চালু থাকা কিন্তু একটা বিরল ঘটনা। এই সুযোগে প্রথম আলোকে আমি ধন্যবাদ জানাব; তাদের কাছ থেকে শুরু থেকেই সহযোগিতা পেয়েছি।

প্রথম আলো: যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ মনন ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা খুবই নাজুক কেন? এই বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন আপনারা তৈরি করতে পারলেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: নাজুক এ জন্য যে পুঁজিবাদের আগ্রাসন বেড়েছে। জ্ঞানচর্চা উৎসাহ পাচ্ছে না। জ্ঞানের বাজারদর কম, উন্নতির জন্য জ্ঞান অপরিহার্য নয়। ২৭ বছর ধরে যে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নেই, এটা তাৎপর্যহীন নয়। এমন ঘটনা কিন্তু আগে কখনো ঘটেনি। ওদিকে মেধা পাচার হয়েছে। যারা বিদেশে গেছে, তাদের অনেকেই ফিরে আসেনি। একাত্তরে যে বুদ্ধিজীবীদের আমরা হারিয়েছি, তার ÿক্ষতিপূরণ ঘটেনি। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। সুবিধা গ্রহণ করার সামাজিক চাপ রয়েছে। ব্যর্থতাটা আলাদা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর নয়, সারা দেশের।

প্রথম আলো: অতীতের কোনো কাজের জন্য আপনার অনুশোচনা হয় কি? যেমন চাপে পড়ে বাকশালে যোগদান, রাইটার্স গিল্ডের পত্রিকা সম্পাদনা করা।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অনুশোচনার কারণ দেখি না। বাকশালে যোগদান ছিল আনুষ্ঠানিকতা। চাপ ছিল দুদিক থেকে। লেখক হিসেবে চাপ এসেছে। বাকশালপন্থী লেখকেরা দ্বারে দ্বারে হানা দিয়ে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন। সেই চাপ নাকচ করে দিতে পেরেছি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাপটা ছিল পুরোপুরি বাধ্যতামূলক ও প্রাতিষ্ঠানিক; উপাচার্য অত্যন্ত তৎপর ছিলেন; শিক্ষক সমিতি ছিল সরকার-সমর্থকদের অধীনে, সমিতির কর্তারা ঘুরে ঘুরে স্বাক্ষর নিয়েছেন। ওই চাপটা নাকচ করা সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া দস্তখত দেওয়া, না দেওয়াকেও খুব বড় ঘটনা বলে মনে করিনি। না দিলে যে বড় একটা অর্জন হতো তা নয়; বাকশাল আসতই।

রাইটার্স গিল্ডের পত্রিকার সম্পাদনাটা ছিল ভিন্ন ব্যাপার। তখন আমাদের কোনো পত্রিকা ছিল না, এমনকি বসার জায়গাও ছিল না। লেখক সংঘের পূর্বাঞ্চলীয় শাখার একটা অফিসঘর ছিল; বাংলা একাডেমির গেটে, আগে যেখানে পাহারাদারেরা বসতেন, সেখানে। লেখক সংঘের একটা অনিয়মিত পত্রিকা ছিল, নাম লেখক সংঘ পত্রিকা। মুনীর চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা লেখক সংঘ-এ নির্বাচিত হই এবং পরিক্রম নাম দিয়ে পত্রিকাটিকে মাসিক পত্রিকায় রূপান্তর করি। শুরুতে পত্রিকার সম্পাদক ছিলাম আমরা দুজন—আমি ও রফিকুল ইসলাম। পরে অবশ্য আমাকে একক দায়িত্ব নিতে হয়। ষাটের দশকে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। আমরা মনে করতাম এটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। লেখক সংঘ-এর পূর্বাঞ্চল শাখায় পরবর্তী সময়ে সম্পাদনের দায়িত্ব পালন করেছেন হাসান হাফিজুর রহমান; তিনিও পরিক্রম পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন; একসময়ে পত্রিকার দায়িত্ব দেওয়া হয় আবদুল গনি হাজারীকে। লেখক সংঘ-এর সম্পাদকদের মধ্যে খান সারওয়ার মুরশিদও ছিলেন। ড. কাজী মোতাহার হোসেন, ড. মুহম্মদ এনামুল হক ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরও বিভিন্ন সময়ে লেখক সংঘ-এর দায়িত্ব পালন করেছেন। লেখক সংঘের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না, পত্রিকার ওপর তো নয়ই।

প্রথম আলো: দেশভাগ নিয়ে আপনার একাধিক পা‌ণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা আছে। আপনার জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি—দুই বাংলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। কিন্তু একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণাধর্মী কোনো কাজ করলেন না বিতর্কের ভয়ে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কাজ করেছি। ‘একাত্তরের যুদ্ধ ও জাতীয়তাবাদের সীমা’ নামে আমি নতুন দিগন্ত-এ লিখছি। দুটি প্রবন্ধ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে। আরও লিখব বলে আশা রাখি।

প্রথম আলো: আপনারা বেশ উৎসাহের সঙ্গে অক্টোবর বিপ্লব শতবার্ষিকী পালন করলেন। সমাজে তো তেমন প্রভাব রেখেছে বলে মনে হয় না। বামপন্থীরা আরও দুর্বল হয়েছে। তাহলে এসব বার্ষিকী উদ্‌যাপনের অর্থ কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অক্টোবর বিপ্লব ছিল একটি সামাজিক ও আন্তর্জাতিক বিপ্লব। রেনেসাঁর পর এমন বিপ্লব দ্বিতীয়টি ঘটেনি। উদ্‌যাপনের প্রভাব যে পড়েনি, তা কিন্তু নয়। পড়েছে। মানুষের মনে ব্যক্তিমালিকানা নিয়ে সংশয় জেগেছে। সামাজিক মালিকানার ব্যাপারটা নাড়াচাড়া দিয়েছে। মিডিয়া কিন্তু আমাদের প‌ক্ষেÿ ছিল না। প্রথম কারণ, উদ্‌যাপনে অতিনাটকীয়তা ছিল না; দ্বিতীয় কারণ, উদ্‌যাপন ছিল পুঁজিবাদবিরোধী। ওদিকে বামপন্থী মানেই যে আপসহীন সমাজবিপ্লবী, এটা সত্য নয়। দেশে বর্তমানে যে হতাশা বিরাজ করছে, তার সমাধান বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়া যে সম্ভব নয়, এই বোধটা কিছুটা হলেও শক্তিশালী হয়েছে। সমাজবিপ্লবের দায়িত্বটা কিন্তু কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর নয়, সব বুদ্ধিমান ও হৃদয়বান মানুষেরই।

প্রথম আলো: আপনি সম্প্রতি একটি লেখায় বলেছেন, নির্বাচিত সরকার মানেই গণতান্ত্রিক নয়। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো উপায় নেই। আগামী নির্বাচন কেমন হবে বলে মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: নির্বাচিত সরকার মানেই যে গণতান্ত্রিক সরকার নয়, এই সত্যটা তো আমাদের অভিজ্ঞতার ভেতরেই রয়েছে। অতীত ইতিহাস বলবে, উত্তেজনা সৃষ্টি করে কট্টর ফ্যাসিবাদীরাও নির্বাচিত হয়ে এসেছে। নির্বাচন যদি অবাধ না হয়, তাহলে তাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে না; সংসদে বিরোধী দল অনুপস্থিত থাকলে জবাবদিহির দায়িত্ব পালনকে গুরুত্ব না দিয়ে সরকার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারে। জবাবদিহি না থাকলে সরকার গণতান্ত্রিক থাকে না, স্বৈরাচারী হয়ে পড়ে। সুষ্ঠু নির্বাচন তাই অপরিহার্য। আগামী নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে বেশির ভাগ মানুষই চি‌ন্তিত। আমিও।

প্রথম আলো: যেকোনো দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় নাগরিক সমাজের অগ্রণী ভূমিকা থাকে। আপনারা সেটি রাখতে পারলেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বিদ্যমান ব্যবস্থায় নাগরিক সমাজ বিশেষ বিশেষ সমস্যা, স্থানীয় সমস্যা ইত্যাদি নিয়ে কাজ করতে পারে। করছে। কিন্তু তাদের ভূমিকা খুবই সীমিত। তারা অরাজনৈতিক। ওদিকে মূল সমস্যাটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া সমস্যার সমাধান হবে না।

প্রথম আলো: আপনারা পুঁজিবাদী সমাজের সবকিছু খারাপ বলেন। কিন্তু বিশ্বের বড় বড় আবিষ্কার, গবেষণা ও সাহিত্য তো এই সমাজেরই দান। কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সামন্তবাদের অবরোধ ছিন্ন করে পুঁজিবাদ যখন আত্মপ্রকাশ করে, তখন তার ভূমিকাটি ছিল মূলত প্রগতিশীল। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, শিল্পে-সাহিত্যে তার অবদান ছিল চমকপ্রদ। কিন্তু ভেতরে সমস্যাটা ছিল মালিকানার। ৯০ জনকে বঞ্চিত করে, দমিত রেখে মালিকানা রয়ে গেছে ১০ জনের হাতে। ছলেবলেকৌশলে পুঁজিবাদ এগিয়ে গেছে। ছাড় দিয়েছে, ভান করেছে উদারতার, পীড়ন ও লুণ্ঠন করেছে, ভয় দেখিয়েছে সর্বক্ষণই; এখন সে পৌঁছে গেছে তার শেষ সীমায়। এই সীমা চরম বর্বরতার। এখন সে আর প্রগতিশীল নয়, এখন সে পরিপূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল।

প্রথম আলো: একজন চিন্তাশীল মানুষ হিসেবে যা ভাবেন, তা কি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন? যদি না পারেন, সেই বলার পরিবেশ তৈরি করতে আপনারা সম্মিলিতভাবে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, বলতে পারি না। সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেওয়ার আগে তো সম্মিলিত হতে হবে। সেটাই সম্ভব হচ্ছে না। একটা কারণ মতাদর্শিক অস্বচ্ছতা; অন্য কারণ সুবিধাবাদিতা, যা পাও, তা হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক, এই মনোভাব।

প্রথম আলো: একজন শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার বর্তমান দুরবস্থাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এই বুর্জোয়া শিক্ষাব্যবস্থাই তো অতীতে আদর্শ ও মহৎ মানুষ তৈরি করেছে। এখন পারছে না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: কয়েকজন মানুষকে দিয়ে কিন্তু গোটা ব্যবস্থার বিচার হবে না। দেখতে হবে সচেতনতা কতটা গভীর ও ব্যাপক ছিল। মতাদর্শিক চিন্তা কিন্তু বিকশিত হয়নি। আমরা কোনো সর্বজনীন মূল্যবান উত্তরাধিকার পাইনি। আর বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব পুঁজিবাদকে বাদ দিয়ে? শিক্ষা যে পণ্য হয়ে গেছে, সেটা তো মিথ্যা কথা নয়। এ তো আমাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। জ্ঞানের দরকার নেই, ভালো ফল পেলেই হলো—এই মনোভাবও সর্বত্র বিরাজমান।

প্রথম আলো: বর্তমানে দেশে যে গণতন্ত্রের সংকট চলছে, উত্তরণের উপায় কী। আশা করি এখানেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলে প্রশ্নটি এড়িয়ে যাবেন না।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপাতত যা দরকার তা হলো এমন একটা নির্বাচন, যাতে জনমতের যথার্থ প্রতিফলন ঘটবে, প্রত্যেকে অবাধে ও নির্ভয়ে ভোট দিতে পারবে, কারচুপি হবে না।

প্রথম আলো: ভবিষ্যতের বাংলাদেশে কোনো আশা দেখছেন কি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: অবশ্যই দেখছি। অবস্থা খারাপ হয়েছে, খারাপ হচ্ছে; কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। অতীতে আমরা সংগ্রাম করেছি, ভবিষ্যতেও করব। মুক্তিযুদ্ধ আর্থসামাজিক মুক্তি আনেনি এটা ঠিক, কিন্তু অতিশয় পরাক্রমশীল একটি শক্তিকে যে হটিয়ে দিয়েছে, সেটাও তো সত্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমাজবিপ্লবের চেতনা। সেই চেতনা এ দেশের মানুষ ধারণ করে; যা প্রয়োজন তা হলো, মুক্তির অসমাপ্ত লড়াইটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেটা মেহনতি মানুষই করবে, সঙ্গে থাকবে সমাজবিপ্লবে বিশ্বাসীরা, অর্থাৎ যারা হৃদয়বান ও বুদ্ধিমান একই সঙ্গে। একাত্তরের যুদ্ধেও কিন্তু মূল শক্তিটা ছিল মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণই।

প্রথম আলো: ধন্যবাদ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ধন্যবাদ।