তবু খুশি বাংলাদেশের মানুষ

যে দেশে ফুটবল নিয়ে এত উন্মাদনা, সেই দেশের ফুটবল খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে।  ছবি: ফোকাস বাংলা
যে দেশে ফুটবল নিয়ে এত উন্মাদনা, সেই দেশের ফুটবল খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছে। ছবি: ফোকাস বাংলা

১৯৯২ সাল। গালে অপারেশনের পর আড়াআড়ি ব্যান্ডেজ করা হয়েছে, শরীরও দুর্বল। কিন্তু তাতে কী! স্টেডিয়ামে গিয়ে আবাহনী-মোহামেডানের খেলা না দেখার কথা ভাবতে পারিনি সেদিনও।

সেসব সময়ে এই খেলার দিন স্টেডিয়াম থাকত লোকে লোকারণ্য। সাংবাদিক কার্ডের ভরসায় আমরা একটু দেরিতে সেখানে গিয়ে দেখি বিশেষ প্রবেশপথ দিয়ে ঢোকাই দুঃসাধ্য হয়ে গেছে ততক্ষণে। বিচিত্রার ক্রীড়া প্রতিবেদক তাঁর গাট্টাগোট্টা শরীর নিয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে আমার এক হাত ধরে সামনে টানেন। পেছন থেকে পুলিশ টানে আরেক হাত ধরে।

কোনোমতে গালের ব্যান্ডেজ বাঁচিয়ে গ্যালারিতে বসেছি। খেলা শুরু হবে মাত্র। চারপাশ গমগম করছে উত্তেজনায়। দেখি পাশের মানুষ সব ভুলে বারবার তাকাচ্ছে আমার লাল হয়ে যাওয়া ব্যান্ডেজের দিকে। আমি তাঁর দিকে ফিরতেই তিনি অবাক কণ্ঠে বলেন: ‘ওই মিয়া, খেলা তো সুরু ভি অয়নি! আপনের চোপা ফাটাইল কেঠা!’

আবাহনী-মোহামেডান খেলা হবে, কারও গাল-চাপা ফাটবে না, রাস্তায় রাস্তায় মারামারি হবে না, দর্শক নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে টিয়ার গ্যাস আর লাঠিপেটা করতে হবে না, পুরো শহর দুই দলের পতাকায় ছেয়ে উঠবে না, তখন এ ছিল অকল্পনীয় বিষয় এ দেশে! এই দুই দল তো আছেই, এমনকি রহমতগঞ্জ, ব্রাদার্স বা ওয়ারীর মতো দলগুলোর খেলায় থাকত টান টান উত্তেজনা। এদেরও শুধু অনুশীলন দেখার জন্য ফজরের আজানের সময় উঠে এসে ভিড় করতেন সমর্থকেরা।

বিশ্বকাপ মৌসুম এলে এসব কথা আমাদের বয়সী মানুষের নিশ্চয়ই মনে পড়ে। আজকের মেসি-রোনালদো নিয়ে পত্রিকা আর সমর্থকের যে
মাতামাতি, তার চেয়ে একটুও কম ছিল না আবাহনীর সালাউদ্দিন আর মোহামেডানের এনায়েতকে নিয়ে! মুন্না, কায়সার হামিদ, নান্নু, মঞ্জু, বাদল রায়—এঁরা কেউই আজকের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-স্পেন-জার্মানির কোনো সুপারস্টারের চেয়ে কম উন্মাদনা সৃষ্টি করেননি বাংলাদেশে।

এমন এক দেশে ফুটবল এখন পরিণত হয়েছে জাতীয় লজ্জায়। আবাহনী-মোহামেডান খেলাতেও স্টেডিয়ামে দর্শক থাকে না। জাতীয় দলের ফুটবলারদের নাম জানে না মানুষ ঠিকমতো। আগে নানা পর্যায়ের ফুটবল টুর্নামেন্ট হলেও এখন সেগুলো হয় না। মানের দিক দিয়েও ফুটবলে আমরা এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিম্নমানের দলগুলোর একটি।

ফুটবলের এই অধঃপতন সবচেয়ে করুণ হয়ে বুকের মধ্যে বাজতে থাকে বিশ্বকাপের এই সময়টাতেই। অবাক হয়ে ভাবি, কেমন করে,
কীভাবে হলো এত বড় একটা অধঃপতন। আরও আশ্চর্য, এ নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই ফুটবল ঘরানার মধ্যেই।

২.

ফুটবলে আমরা কখনোই বড় কোনো শক্তি ছিলাম না। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় অন্তত সম্মানজনক একটা অবস্থান ছিল আমাদের। ফুটবল প্রশাসন বলে একটা জিনিস ছিল, দেশে নিয়মিত ফুটবল লিগ হতো, এমনকি চতুর্থ স্তর পর্যন্ত, ফুটবলারদের সম্মান, সম্মানী, জনপ্রিয়তা সবই ছিল তখন। সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, ফুটবল নিয়ে একটা স্বপ্ন ছিল আমাদের।

ফুটবলের ধারাবাহিক দুর্দশা শুরু প্রায় দেড় যুগ ধরে। এর মাঝে প্রায় ১০ বছর আগে কাজী সালাউদ্দিন ফুটবল ফেডারেশন প্রধানের দায়িত্ব পেলে ফুটবল নিয়ে নতুন আশাবাদের সূচনা ঘটে। এর কারণ ছিল। আমরা যখন ফুটবল খেলা দেখতাম, তখন তো বটেই, বাংলাদেশের ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম খেলোয়াড় ধরা হয় কাজী সালাউদ্দিনকে। আজকে ক্রিকেটে যেমন সাকিব, তিনি ফুটবলে আমাদের আমলে তেমনি ছিলেন। সে যুগে তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পেশাদার ফুটবল খেলেছেন হংকংয়ের প্রথম বিভাগের দলে। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, আচার-আচরণ, চলন-বলনেও তিনি বরাবরই অত্যন্ত স্মার্ট একজন মানুষ।

এমন একজন ব্যক্তি দায়িত্ব নেওয়ার পর আশা ছিল ফুটবলের কিছুটা অন্তত উন্নতি হবে দেশে। সবই ছিল তাঁর অনুকূলে। ফুটবলের আদ্যোপান্ত ছিল তাঁর জানাশোনা। দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর সময় পেয়েছেন তিনি। করপোরেট দুনিয়ার বহু জায়ান্ট তাঁর চেনাজানা।

অথচ আমরা দেখছি, ফুটবল খুবই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আন্তর্জাতিক অবস্থানে প্রায় ৫০ ধাপ অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০০৯ সালে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৪৭। এখন ১৯৪, একবার তা নেমেছিল ১৯৭-এ। ফুটবলপাগল ১৬ কোটি লোকের এ দেশের ওপর আছে এখন ২৬ কিলোমিটার আয়তনের ম্যাকাও, ৩৮ হাজার লোকের দেশ লিখটেনস্টাইন আর হতদরিদ্র দক্ষিণ সুদানের মতো দেশ। যে ভারতকে আমরা দু-একবার হলেও ছাড়িয়ে যেতাম র‍্যাঙ্কিংয়ে, এখন তাদের চেয়ে আমাদের অবস্থান প্রায় ১০০ ধাপ নিচে। ভাবা যায় এসব?

মানের এই অবনতি এমনি এমনি হয়নি। তাঁর সময়কালে চমক দেখানো কিছু টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়েছে। সালাউদ্দিন নিজে ফিফার আঞ্চলিক পর্যায়ের নেতা হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, নতুন নতুন দাপট দেখানো ক্লাবের জন্ম হয়েছে। কিন্তু ক্লাব ফুটবল আগের সেই জনপ্রিয়তা ফিরে পায়নি। ফুটবলকে দর্শকপ্রিয় করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি। আমরা দেখেছি ফুটবলে ফুটবল-চিন্তাহীন মানুষের তর্জন-গর্জন বেড়েছে। ফুটবল নিয়ে চিন্তা ও পরিকল্পনার ছাপ মেলেনি।

আমি ফুটবল বিশেষজ্ঞ নই। দেশে ফুটবলের এতটা অধঃপতন কেন হয়েছে, তা বলতে গিয়ে আমার ভুল হতে পারে। কিন্তু অধঃপতন যে হয়েছে, সেটা নিশ্চিতভাবে দেশের যেকোনো মানুষের মতো আমিও বলতে পারব। গত চার বছরে প্রতিবেশী দেশ ভারত ৮০ ধাপ এগিয়েছে ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে। আর আমরা এই সময়ে উল্টো পিছিয়েছি প্রায় ৩০ ধাপ! কেন, কীভাবে হলো এসব—এ নিয়ে বাংলাদেশে ফুটবল ফেডারেশনের আদৌ কোনো চিন্তাভাবনা আছে? অথবা এই পরিস্থিতি দূর করার পথ খোঁজার চেষ্টা? এতটুকুও কি বিচলিত তারা এসব নিয়ে? ফুটবল ফেডারেশন বা এর কর্তাদের কি এ জন্য কোনো জবাব দিতে হয় কারও কাছে?

৩.

মাঝে মাঝে এ-ও ভাবি, ফুটবলে ব্যর্থতার দোষটা কি শুধু ফুটবল ফেডারেশনের, এর সভাপতির, নাকি জবাবদিহিহীন এক রাষ্ট্রব্যবস্থার? এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো ব্যর্থতার জন্যই কাউকে পদ ছাড়তে হয় না, এমনকি জবাবও দিতে হয় না। বছরের পর বছর প্রশ্ন ফাঁস হলে শিক্ষামন্ত্রী বহাল তবিয়তেই থাকেন। একের পর এক ব্যাংক লুট হলে এর দায়ে অর্থমন্ত্রীকে জবাবদিহি করতে হয় না। এই দেশে ফুটবলে অবনমন এমন আর কী বিষয়!

বাফুফের সভাপতির বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ শোনা যায়। তিনি নিজের মতো চলেন। গুছিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার চেয়ে চটজলদি কোনো চমক সৃষ্টিতে তাঁর আগ্রহ বেশি। এসব অভিযোগ যদি সত্যিও হয়, তারপরও তো তিনি সালাউদ্দিন। বিশ্বকাপের এই দিনগুলোতে তিনি যখন দেশে-বিদেশে কোথাও যান, তাঁর কি মনে হয় না অতি দুর্বল এক ফুটবল জাতির প্রতিনিধি তিনি। জানতে ইচ্ছা করে, এই নিমজ্জনের দায়টা তিনি কতটা অনুভব করেন?

৪.

এ দেশে ফুটবলের কোটি কোটি দর্শক আছে, ফুটবল উন্মাদনা আছে, ফুটবল নিয়ে রাত উজাড় করে দেওয়া আলোচনা আছে। এসব আগ্রহ-উদ্দীপনা আমাদের নিজেদের ফুটবল নিয়েও ছিল। এত দিনে তা আরও বহু গুণ বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমাদের সমস্যা ফুটবল প্রশাসন নিয়ে। দীর্ঘমেয়াদি তৃণমূলভিত্তিক কোনো পরিকল্পনা নেই আমাদের ফুটবল নিয়ে।

আরও বহু কিছুর পর ফুটবলে আমাদের অপ্রাপ্তি তাই বলে কেড়ে নিতে পারেনি আমাদের ফুটবল-হৃদয়। বিশ্বকাপ হচ্ছে, ভালো ফুটবল হচ্ছে—এতেই খুশি আমরা বাংলাদেশের মানুষ। আমরা তাই ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে ঝগড়ায় মাতি, এদের পতাকায় ছেয়ে ফেলি দেশ, জমি বেচে গাই এদের প্রশস্তি।

এমন আবেগময় একটা জাতিকে যাঁরা নেতৃত্ব দেন, ফুটবলে বা অন্য কিছুতে, তাঁরা কি কখনো ভাবেন, সত্যিকার কোনো সাফল্য দেশকে দিতে পারলে কী অতল ভালোবাসার প্লাবনে সিক্ত হতেন তাঁরা!


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক