আমরা মানুষ না ইঁদুর?

ট্রাফিক পুলিশের হতাশা

রাজধানীর বাংলামোটরের চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে যানবাহনের চলাচল দেখি। বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, রিকশা—কোনো যান স্বাভাবিক গতিতে চলছে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। যানজটে একদম থেমে থাকা, কিংবা রাস্তা একটু ফাঁকা পেলেই পরস্পরকে পাল্লা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটার প্রতিযোগিতা—এই হলো প্রত্যেকের মনের অবস্থা। কেউ কারও পিছে পড়তে রাজি নয়; সারি ধরে চলা যেন ভুলে গেছে সবাই। যেতে হবে পাশ কেটে, গুঁতো মেরে, ঘষা খেয়ে। ট্রাফিক পুলিশের সদস্য বাঁশি বাজিয়ে, হাত তুলে, লাঠি উঁচিয়ে, সড়কের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়াদৌড়ি করে গলদঘর্ম, তবু
অধৈর্য বাসচালকেরা যেন তাঁর গায়ের ওপরে তুলে দেবেন বাসটা। মোটরসাইকেলের ঝাঁক শুধু ফাঁক খুঁজবে, তাদের চলার পথের কোনো উল্টা-সিধা
নেই; তাদের সড়কে-ফুটপাতে ভেদাভেদ নেই। রিকশার দঙ্গলকে সামলাবে এমন সাধ্য দুনিয়ায় কারও নেই।

যুবক ট্রাফিক পুলিশের রোদে পোড়া ঘাম-চকচকে মুখমণ্ডলে বিরক্তি, বীতস্পৃহা, হতাশা, অসহায়তার সমস্ত চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: ভুরু কোঁচকানো, কপালে অজস্র ভাঁজের ঢেউ খেলে যাচ্ছে। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ল। বললাম, ‘কী অবস্থা, ভাই?’

‘সম্ভব না।’ হাল ছেড়ে দেওয়ার সুরে তিনি বললেন। হেসে বললাম, ‘কী সম্ভব না?’

‘এইটা ম্যানেজ করা সম্ভব না।’ তিনি বোঝাতে চাইলেন ট্রাফিকব্যবস্থা ম্যানেজ করা সম্ভব নয়, ‘অসম্ভব হইয়া গেছে। কারও সাধ্য নাই এইটা ম্যানেজ করে।’

‘অবস্থা ভালো হবে কবে?’ আমার জিজ্ঞাসা।

‘কোনো কালেই না।’

‘কেন?’

‘মানুষ বেশি হইয়া গেছে।’

‘কিন্তু বেশি মানুষ নাকি কোনো সমস্যা না?’

‘কে বলে?’

‘সরকার বলে। বেশি জনসংখ্যা কোনো সমস্যা না, বরং সম্পদ।’

ট্রাফিক পুলিশের সদস্যটির মুখে যে হাসি ফুটে ওঠে, তা স্পষ্টতই পরিহাসের। তিনি বলেন, ‘এখন তো এই অবস্থা, পদ্মা সেতু চালু হইলে দক্ষিণবঙ্গ থিকা যখন ডেইলি হাজার হাজার যানবাহন ঢাকায় আইস্যা ঢুকব, তখন দেখবেন কী অবস্থা কী হয়।’

বৃহৎ জনগোষ্ঠী: বোঝা না শক্তি

অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে শুধু যে রাজধানীর ট্রাফিকব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে তা নয়; গোটা দেশের সমগ্র জনজীবনে এক ‘আনম্যানেজেবল সিচুয়েশন’ বা সামলানোর অযোগ্য পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ বেশি, জায়গা কম—সবকিছুর জন্য জায়গা কম: চাষাবাদের জায়গা কম, বসবাসের জায়গা কম, রাস্তাঘাটের জায়গা কম, কলকারখানা স্থাপনের জায়গা কম, হাসপাতালে রোগীদের জন্য জায়গা কম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জন্য জায়গা কম, শিশুদের খেলাধুলার জায়গা কম, এমনকি হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগল পালার জন্যও জায়গা কম। আর জায়গা কম বলেই জায়গাজমি নিয়ে মারামারি-খুনোখুনি। জায়গা কম বলেই ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদ-নদী, খাল-বিল, দিঘি-পুকুর; উজাড় হয়ে যাচ্ছে বনজঙ্গল।

জায়গার অনুপাতে মানুষের সংখ্যা বেশি হলে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই ঘাটতি পড়ে—এটুকু বুঝতে কোনো গবেষণার প্রয়োজন হয় না। তবু যখন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বলেন যে বেশি মানুষ কোনো সমস্যা নয়, তখন প্রশ্ন জাগে—এই অভিমতের যুক্তি কী? নীতিনির্ধারকেরা বলেন, মানুষ হলো জনশক্তি, কারণ তারা কাজ করে সম্পদ উৎপাদন করে। তাই ‘বৃহৎ জনগোষ্ঠী কোনো বোঝা নয়, বরং শক্তি’—এ রকম বক্তব্য উচ্চারিত হয় আমাদের জাতীয় সংসদে।

কিন্তু ‘বৃহৎ’ জনগোষ্ঠীর আকার কতটা বৃহৎ হলে তা আর শক্তি না থেকে বোঝায় পরিণত হতে পারে? বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আকার কি এখন পর্যন্ত
ততটা বৃহৎ হয়ে ওঠেনি? দেখুন, আমাদের এই দেশটার আয়তন মাত্র ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার, কিন্তু জনসংখ্যা ইতিমধ্যে ১৬ কোটি ৬৪ লাখে পৌঁছেছে। এই দেশে এখন এক কিলোমিটার জায়গায় বাস করছে ১ হাজার ১২০ জন মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি জনবহুল দেশ চীন (মোট জনসংখ্যা ১৪১ কোটি), সেখানে প্রতি এক কিলোমিটারে বাস করে মাত্র ১৪৫ জন। ম্যাকাও, মোনাকো, সিঙ্গাপুর, হংকং—এ রকম কয়েকটি ক্ষুদ্র দ্বীপ ও নগররাষ্ট্রের কথা বাদ দিলে বাংলাদেশের জনঘনত্ব এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আর দক্ষিণ এশিয়ার কথা বললে বাংলাদেশ এক অকল্পনীয় মাত্রার জনঘনত্বের দেশ। ভারতের জনঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৩৬৪, পাকিস্তানের ২৪৫, নেপালের ১৯, আর ভুটানের মাত্র ৪৬।

প্রশ্ন হলো, যখন এক কিলোমিটার জায়গায় ১ হাজার ১২০ জন মানুষকে বাস করতে হয়, তখন সেই জনগোষ্ঠী কি আর ‘জনশক্তি’ থাকে, নাকি বোঝা
হয়ে ওঠে? ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটার জন্য আমরা কি বোঝা হয়ে দাঁড়াইনি?

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয়ই বলবেন: না। আমরা বোঝা নই, আমরা শক্তি। এবং ২ দশমিক ৩ প্রজনন হার নিয়ে, প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ করে বাড়তে বাড়তে আমরা আরও বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হচ্ছি। আমাদের ৭ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে; আমাদের শনৈঃ শনৈ উন্নতি হচ্ছে, আমরা এক বছরে ৪ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করার পরিকল্পনা করতে পারছি, আমাদের শিক্ষা বাড়ছে, স্বাস্থ্য বাড়ছে, আয়ু বাড়ছে, গ্রাম বাড়ছে, নগর বাড়ছে—আমরা উন্নয়নের রাজপথ, অলিগলি ধরে সরসর করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছি।

জন ক্যালহুনের ইঁদুর

আমাদের এই বৃদ্ধির, এই উন্নয়নের দৃশ্যের তলে চাপা পড়া কোটি কোটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের দৃশ্য চোখ বন্ধ করে কল্পনা করলে আমার মনের চোখে ভেসে ওঠে মার্কিন সমাজবিজ্ঞানী জন ক্যালহুনের ইঁদুর রাজ্যের ছবি। এই ভদ্রলোক পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ইঁদুরদের নিয়ে এক কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণায় মেতে উঠেছিলেন। তাঁর কৌতূহলের বিষয় ছিল স্বাভাবিক বসবাস ও স্বচ্ছন্দে চলাফেরার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় কোনো প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা যদি ক্রমে বাড়তে থাকে, তাহলে কী ঘটতে পারে। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় তিনি কয়েক জোড়া নিরোগ, পূর্ণবয়স্ক মেয়ে ও পুরুষ ইঁদুর রেখে দিলেন, তাদের নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবারের ব্যবস্থা করলেন, বাসা বানাবার সরঞ্জামও রেখে দিলেন। তিনি নিশ্চিত করলেন, বিড়াল বা অন্য কোনো ইঁদুরখেকো প্রাণী যেন ইঁদুরদের ওই ঘরে ঢুকতে না পারে।

অর্থাৎ বসবাসের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা, পর্যাপ্ত খাবার, বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা যাবতীয় কিছু দিয়ে জন ক্যালহুন তাঁর ইঁদুরদের এই বাসস্থানের নাম দিলেন ‘মাউস প্যারাডাইস’ বা ইঁদুর স্বর্গ। সেই স্বর্গে ইঁদুরেরা পরমানন্দে ভোজন ও বংশবিস্তার করে চলল। একপর্যায়ে ক্যালহুন ও তাঁর গবেষণা দলের সদস্যরা লক্ষ করলেন, ইঁদুরেরা তাদের ঘরটির মাঝখানে রাখা খাবারের পাত্রগুলোর চারপাশে ভিড় করছে। চার প্রান্তে ও কোনায় খাবারের পাত্র আছে, সেগুলোতে পর্যাপ্ত খাবারও আছে, কিন্তু বেশির ভাগ ইঁদুর জড়ো হচ্ছে মাঝখানের খাবারের পাত্রগুলো ঘিরে। ভিড় দেখে ভিড়ের দিকেই ছুটে যাচ্ছে অন্যরা। ফলে সেখানে ঠেলাঠেলি, মারামারি, কামড়াকামড়ি লেগে যাচ্ছে। ইঁদুর স্বর্গের সুখশান্তিময় পরিবেশ ক্রমেই অশান্ত, অস্থির হয়ে উঠছে।

জন ক্যালহুন ইঁদুরদের এই ভিড় জমানোর প্রবণতার নাম দিলেন ‘প্যাথলজিক্যাল টুগেদারনেস’, বাংলায় বলা যেতে পারে একত্র হওয়ার বা ভিড় জমানোর এমন প্রবল ঝোঁক, যা রোগপর্যায়ের মতো অস্বাভাবিক। পরবর্তী সময়ে নগরায়ণ ও নগরকেন্দ্রের অধিবাসীদের মনোস্তত্ত্ব ও আচরণ নিয়ে গবেষণা করেছেন এমন অনেকেই ক্যালহুনের ইঁদুরদের এই প্যাথলজিক্যাল টুগেদারনেসের সঙ্গে নগরমুখী মানুষের মনস্তত্ত্বের তুলনা করেছেন। আমেরিকার বিজ্ঞানবিষয়ক লেখক ও সাংবাদিক রবার্ট আরড্রে ১৯৭০ সালে এক প্রবন্ধে মন্তব্য করেন, ‘ক্যালহুনের ইঁদুরেরা যেভাবে মাঝখানের খাবারের পাত্রগুলো বেছে নেয়, ঠিক সেইভাবে আমরা শহরের দিকে ছুটি।’ সারা বাংলাদেশের মানুষের ঢাকামুখী ঢলের কথা এই প্রসঙ্গে মনে এসে পড়ে।

এতেই শেষ নয়। ইঁদুরের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে ক্যালহুনের গবেষক দলের সদস্যরা দেখতে পেলেন ইঁদুরদের স্বর্গটি নরকে পরিণত হতে চলেছে: দাপুটে পুরুষ ইঁদুরেরা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে; তারা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়, একে মারে, ওকে কামড়ায়। তারা আক্রমণ চালায় বিশেষত মেয়ে ও বাচ্চা ইঁদুরদের ওপর। তাদের যৌন আচরণে ভীষণ পরিবর্তন দেখা দেয়: কিছু ইঁদুর সম্পূর্ণভাবে সমকামী হয়ে ওঠে, আর একদল হয়ে ওঠে সর্বকামী (প্যানসেক্সুয়াল)। আর একদল হয় অতিকামী (হাইপারসেক্সুয়াল), তারা সামনে যাকে পায় তার ওপরেই উঠে পড়ার চেষ্টা করে। তাদের অত্যাচারে মেয়ে ইঁদুরেরা অতিষ্ঠ হয়ে ঘরসংসার ছেড়ে পালিয়ে বেড়ায়, বাসা বানাতে পারে না, বাচ্চাদের যত্ন নেয় না, কখনো কখনো এমনকি নিজের বাচ্চাদেরই কামড়ায়। ফলে বাচ্চারা মরতে থাকে, ইঁদুর রাজ্যের কোনো কোনো অংশে বাচ্চাদের মৃত্যুর হার এমনকি ৯৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ওঠে। দাপুটে অত্যাচারী ইঁদুরদের উপদ্রবে নরম-সরম প্রকৃতির ইঁদুরেরা মানসিকভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, তারা ঘরটির প্রান্ত ও কোনাগুলোর দিকে সরে যায়। ক্যালহুন বলেন, এই ইঁদুরেরা শারীরিক অর্থে বেঁচে থাকে বটে, তবে তা বিরাট মনস্তাত্ত্বিক মাশুলের (ইমেন্স সাইকোলজিক্যাল কস্ট) বিনিময়ে। যৌন আচরণ বদলে যাওয়া ও সহিংস নৈরাজ্যের ফলে একটা পর্যায়ে একদিকে ইঁদুরদের বংশবিস্তার কমে যায়, অন্যদিকে বাচ্চা ইঁদুরদের সিংহভাগই মারা যায়।

জন ক্যালহুন এই পরীক্ষার উপসংহার টানেন এভাবে: ইঁদুরদের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ বসবাস ও বিচরণের জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার তুলনায় তাদের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেলে তাদের মধ্যে সামগ্রিক আচরণগত বিপর্যয় ঘটে; এটাকে তিনি বলেছেন ‘বিহেভিয়ারাল সিংক’। জনঘনত্ব বাড়ার একটা পর্যায়ে তাদের আচরণগত বিপর্যয় এমন মারাত্মকভাবে পাকাপোক্ত হয়ে যায় যে ইঁদুরেরা শান্তিপূর্ণভাবে মিলেমিশে বাস করার সামর্থ্য স্থায়ীভাবে হারিয়ে ফেলে। অনেক ইঁদুরের মৃত্যুর ফলে তাদের মোট সংখ্যা কমে আবার আগের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেলেও তারা আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সামর্থ্য ফিরে পায় না। অর্থাৎ, জনঘনত্বের একটা পর্যায়ে গিয়ে তাদের আচরণ আর ইঁদুরের মতো থাকে না।

প্রিয় পাঠক, ক্যালহুনের ইঁদুর রাজ্যের এই চিত্রের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের চিত্র মিলিয়ে দেখুন। কিছু কি মেলে?

মশিউল আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক