কে বাঁচাবে টেলিভিশনের নাটক?

আমাদের শৈশবে টিভি চ্যানেল ছিল মাত্র একটি—বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। কিন্তু এই একটি টেলিভিশন চ্যানেল যে কী করে এত মানুষের বিনোদনের খোরাক মেটাত, তা ভাবলেও অবাক হতে হয়। সব অনুষ্ঠানের কথা বলতে গেলে হয়তো মহাকাব্য রচনা করতে হবে। আমার উদ্দেশ্যও নয় সেটি। আমি শুধু সেই সময় আর এই সময়ের টেলিভিশন নাটক নিয়ে কিছু বলতে চাই। সেই সময়ের নাটকের কথা বলতে খুব বেশি নাটকের নাম উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। সংশপ্তক, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই, কোন কাননের ফুল কিংবা অয়োময়-এর মতো উচ্চমানসম্পন্ন নাটকের পর বোধকরি আর কোনো নাটকের নাম উল্লেখ না করলেও চলে।

এসব একেকটি নাটক আসলে একেকটি ইতিহাস। এই নাটকের চরিত্রগুলো আজও আমাদের মনে বাস্তব। যদিও তখন আমি অনেক ছোট, তারপরও আবছা মনে পড়ে সংশপ্তক নাটকের হুরমতি আর কানকাটা রমজান চরিত্র দুটির কথা। কোথাও কেউ নেই নাটকের বাকের ভাইয়ের চরিত্রের মতো এত জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত কোনো নাটকের কোনো চরিত্র পেয়েছে বলে মনে হয় না। যেদিন বাকের ভাই চরিত্রটির ফাঁসি হয়েছিল, সেদিন মুষড়ে পড়েছিল সারা দেশ। শেষ পর্বটি প্রচারের আগ পর্যন্ত রাস্তায় মিছিল আর প্রতিবাদ হয়েছিল যেন নাট্যকার নাটকের পরিণতির বিষয়টি আরেকবার বিবেচনা করেন। এই স্মৃতিগুলো মনে হলে আজও স্বপ্নের মতো মনে হয়।

আহা রে, আমাদের আজকের প্রজন্ম! আমাদের বর্তমান প্রজন্ম জানে না বাংলাদেশের টেলিভিশন নাটকের সোনালি অধ্যায়ের কথা। তারা কখনো জানবে না নাটকের ওই অনন্য চরিত্রগুলোর কথা। ওরা কখনো একাত্ম হবে না বাকের ভাইয়ের মতো চরিত্রগুলোর সঙ্গে। সম্প্রতি তথ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, দেশের ৮৩ শতাংশ দর্শক বিটিভি দেখেন। কিন্তু বাস্তবতা এই যে বিটিভি অনেক আগেই তার জৌলুশ হারিয়েছে। সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে হারিয়েছে এর দর্শক। আজ বাংলাদেশে অগুনতি চ্যানেল! কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা সন্তানদের জন্য সৃষ্টি হচ্ছে না গর্ব করার মতো কোনো নাটক বা নাটকের চরিত্র। দোষ কিন্তু ওদের নয়। আজ যদি ওরা আমাদের দেশের নাটক থেকে মুখ ফিরিয়ে বিদেশি অনুষ্ঠানের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, তবে এই দায়ভার কিন্তু আমাদের সবার নিতে হবে।

ব্যক্তিগতভাবে আমি যতবারই সন্তানদের বাংলাদেশের নাটক দেখানোর জন্য টেলিভিশনের সামনে বসাই, ততবার উল্টো নিজেই বিব্রত হই। বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক দেখতে যখন নিজেরই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে, তখন শিশুদের কথা আর নাই-বা বললাম। তাই টিভি রিমোটের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে চ্যানেল পরিবর্তনের ভিন্ন উপায় থাকে না। চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে ঘুরে শুধু দেখি বিজ্ঞাপন, আর কখন কোনো চ্যানেলে কোনো নাটক প্রচারিত হবে তার ফিরিস্তি। নাটক আর দেখা হয়ে ওঠে না আমাদের। শেষ পর্যন্ত আমাদের ঠিকানা হয় ভিনদেশি কোনো টিভি চ্যানেলে।

বিজ্ঞাপনের এই বিড়ম্বনা এড়াতে প্রায়ই শরণাপন্ন হই ইউটিউবের। কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়ে না। তুমি, আমি আর দুখানা মোবাইল ফোন—এই যেন আজকালকার নাটক। নাটকগুলোতে ঘুরেফিরে বারবার আসে কয়েকটি মুখ। একই রকম তাদের বেশভূষা, মুখভঙ্গি আর অভিনয়। যেমন অদ্ভুত নাটকগুলোর নাম, তেমনি বাস্তবতাবর্জিত এসবের কাহিনি। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ নাটকের কাহিনিগুলো একঘেয়ে ও বিরক্তিকর। নির্মাণে
নেই যত্নের ছাপ। দু-তিনটি নাটক পরপর দেখলে বিভ্রান্ত হই একই নাটক দেখছি কি না, নাকি নাটকগুলো আলাদা।

লক্ষ করেছি, আজকাল নায়ক-নায়িকাদের বাবা থাকলে মা থাকেন না, আর মা থাকলে থাকেন না বাবা। বিয়েবাড়ির দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে অতিথিদের ভিড় এড়িয়ে বিয়েবাড়ির উজ্জ্বল আলোকসজ্জা আর সংগীতকে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করে। চরিত্র সীমাবদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা নির্লজ্জভাবে চোখে পড়ে। নাটকগুলো ধারণ করার আগে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা একবারও সংলাপগুলো পড়ে দেখেন কি না সন্দেহ! হাসির নাটকগুলো আজ পরিণত হয়েছে ভাঁড়ামির আড্ডাখানায়। নাটকগুলোতে না আছে রুচিশীল বিনোদন আর না আছে শিক্ষণীয় কোনো বিষয়বস্তু।

আমি একজন সাধারণ দর্শকমাত্র। তাই সাধারণ দর্শকের চোখ দিয়ে দেখে আমি অনুভব করি, এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই চলচ্চিত্রশিল্পের মতো মুখ থুবড়ে পড়বে টেলিভিশন নাটকশিল্প। নাটক নির্মাণে পেশাদারি মনোভাব নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। নাটক প্রচারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতাদের নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। একজন দর্শক হিসেবে বলতে চাই, টেলিভিশন নাটক নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হোক টেলিভিশনের পর্দার গুণগত মানোন্নয়ন; সস্তা চাকচিক্য আর চটুল সংলাপের গোলকধাঁধার ধূম্রজাল সৃষ্টির মাধ্যমে শুধু অর্থ উপার্জন করা নয়। 

নিশাত সুলতানা লেখক ও গবেষক
[email protected]