আওয়ামী লীগের ইতিহাস - তার ভবিষ্যৎ

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান

কোনো দেশে নানা মতাদর্শী বহু রাজনৈতিক দল থাকতে পারে। তার কোনোটি বারবার সরকার গঠন করলেই এবং তা অনেক দিন ক্ষমতায় থাকলেই তার ভূমিকা ঐতিহাসিক নয়। যে রাজনৈতিক সংগঠন ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, তার ভূমিকাই ঐতিহাসিক। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে তিনটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ঐতিহাসিক: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, নিখিল ভারত মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ। উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের (১৮৮৫) নেতৃত্বে ভারতের স্বাধীনতা এসেছে। মুসলিম লীগের (১৯০৬) নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদশের অভ্যুদয় ঘটেছে। এ কারণে এই তিনটি দলের অবস্থান আলাদা। এই তিন দলের রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতাও অন্য কোনো দলের চেয়ে বেশি।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের ‘ভারত শাসন আইন’ পাস হওয়ার পর সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হলে বিশের দশকে কংগ্রেসের বাইরে স্বরাজ্য দলসহ একাধিক আঞ্চলিক দলের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু কংগ্রেসের প্রাধান্য খর্ব করতে পারেনি কোনো দল, তারা সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে ক্ষমতার স্বাদ পেলেও, ১৯৩৫ সালে ‘ভারত শাসন আইন’ গৃহীত হলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন স্বীকৃতি পায়। তখন বাংলা এবং আসামে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বাইরে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টিসহ কয়েকটি আঞ্চলিক দল গঠিত হয়। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে কোনো বড় ভূমিকা রাখতে পারেননি। ১৯৪৬-এ যে সাধারণ নির্বাচন হয় এবং যে নির্বাচনে উপমহাদেশের মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ হয়, সেই নির্বাচনে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের। স্বাধীন ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে কংগ্রেস এবং স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতা হয় মুসলিম লীগ।

লীগ নেতারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কোনো ভূমিকা রাখলেন না। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ পূর্ব বাংলা তার ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। এই প্রদেশের সচেতন নেতা-কর্মী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য ছিল না। তাঁরা সরকারি মুসলিম লীগের বাইরে একটি ‘জনগণের মুসলিম লীগ’ গঠন করেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী হন সভাপতি, যুবনেতা শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং এক নম্বর যুগ্ম সম্পাদক আরেক যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কাউকে প্রশ্ন তুলতে শুনিনি যে দলটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ হলো কেন?

সরকারি মুসলিম লীগের বাইরে যদি আর একটি জনগণের বা ‘আওয়াম’-এর মুসলিম লীগই হবে তাহলে তার নাম হতে পারত এবং হওয়া উচিত ছিল ‘পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। ভাসানী ‘পাকিস্তান’ নামটির জায়গায় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ প্রস্তাব করেন। তাঁর উদ্বেগ ছিল ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন নিয়ে। গঠনের দিনই দলের চারটি লক্ষ্যের মধ্যে দ্বিতীয়টিতে বলা হয়েছিল: ‘পাকিস্তানের ইউনিটগুলিকে [প্রত্যেক প্রদেশকে] আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার দিতে হবে।’ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২২ মাস পরে ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার’-এর আবদার করা চাট্টিখানি কথা ছিল না। কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণির মাথা যত মোটাই হোক, এ কথার অর্থ বোঝার মতো বুদ্ধি তাদের যথেষ্টই ছিল।

শুধু ওই ঘোষণা নয়, প্রতিষ্ঠার ১০ দিন পর ভাসানী যে ১২ দফা ‘কর্মসূচি’র প্রচারপত্রটি বের করেন তার ৩ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল:

‘অঞ্চলগুলি [পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চল] লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করিবে। প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক (রাজনৈতিক) ও মুদ্রাব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। অন্য সকল বিষয় ইউনিটগুলির উপর ন্যস্ত থাকিবে।’

দল কী করবে সেই সম্ভাব্য কর্মসূচির ৯ নম্বর দফায় বলা হয়েছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নিজস্ব স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর ইউনিট গঠন করা হইবে।’ মাওলানা সাহেব বেশি চড়া গলায় কথা বলার মানুষ ছিলেন। তখন জমিদারি ব্যবস্থা চালু ছিল, তিনি ১২ নম্বর দফায় ঘোষণা দিলেন ‘সকল জমি জাতীয়করণ করা হইবে।’ কেন্দ্রীয় শাসকচক্রের ক্রোধ হয়েছিল ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার’-এর কথা শুনে; এদিকে পূর্ব বাংলার জমিদার–জোতদারদের ঘুম হারাম হয়ে গেল ‘জমি জাতীয়করণ’-এর ঘোষণায়। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ, যারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ছিল অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত তারা মনে করল এই এবার একটি দল পাওয়া গেল যে দল তাদের নিজস্ব।

শুধু ঘোষণা দিয়ে অথবা একটি লিফলেট ছেপে বিলি করে ঘরে বসে থাকলে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন জনগণের হতে পারে না। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত নেতাদের ওপর সরকারি নিপীড়ন সত্ত্বেও তিনজন মানুষ—ভাসানী, শামসুল হক এবং শেখ মুজিব—গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছেন। ভাসানীর ভাষায় ‘কোনো দিন দুই আনার মুড়ি খেয়ে আমার আর মজিবরের দিন গেছে’। সেই সময়টির চিত্র বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে কিছুটা আছে। আওয়ামী লীগকে তখন কেউ ঘর ভাড়াও দিতে চায়নি।

আওয়ামী লীগ ৬৯ পার করে ৭০-এ পা দিয়েছে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন, কোনো রাজনৈতিক সংগঠনেরও বয়স কোনো গুণ নয়। তাই যদি হতো তাহলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বয়স্ক দল মুসলিম লীগ। তার আদৌ অস্তিত্ব আছে কি না তা গোয়েন্দারা ছাড়া কোনো মানুষ বলতে পারবে না। কমিউনিস্ট পার্টিও প্রাচীনতর দল। ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) কত ভাগে বিভক্ত এবং কোন অংশের সমর্থক কত, তা আমাদের মতো মানুষের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের অবস্থা তা নয়। উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে দলটি সাবলীলভাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। অতীতে অনেকবার দলটি ক্ষমতায় যেমন ছিল, তেমন বিরোধী দলেও ছিল। বিরোধী দলে থাকার সময়ও শক্ত অবস্থানে ছিল। যে সংগঠন বিরোধী দলে থেকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে না, সে দল সুষ্ঠু ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গিয়েও ভালো করতে পারে না।

সোহরাওয়ার্দীকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতারাও নেতা মানতেন। বাস্তবিক পক্ষে তিনি ছিলেন নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগের প্রধান। ভাসানী-মুজিব-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে চেয়েছেন স্বায়ত্তশাসিত শক্তিশালী পূর্ব বাংলা। আর সোহরাওয়ার্দী চেয়েছেন শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি মনে করতেন, পাকিস্তান শক্তিশালী থাকলে পূর্ব পাকিস্তানও ভালো থাকবে। ভাসানী-মুজিব মনে করতেন, স্বায়ত্তশাসিত পূর্ব পাকিস্তান শক্তিশালী পাকিস্তানের জন্য কোনো সমস্যা নয়। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতির জন্য ক্ষতি ছিল, কিন্তু তাঁর মৃত্যু আওয়ামী লীগকে মুক্তি দিয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে ১৯৬৬ এবং ১৯৭১-এর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগকে আমরা পেতাম না। দেশের ইতিহাস অন্য রকম হতো।

বর্তমান প্রজন্মের আওয়ামী লীগের নেতাদের শোনানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ভূমিকার কথা। কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিরাট। পাকিস্তানি মার্শাল ল এবং বাংলাদেশি সামরিক শাসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করেছে এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতিতে যে প্রত্যাবর্তন, তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে দিতে হবে।

উপমহাদেশের রাজনীতি যতটা নীতিনির্ভর, তার চেয়ে বেশি নেতানির্ভর। কংগ্রেসে মহাত্মা গান্ধী, লীগে জিন্নাহ যেমন, তেমনি পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগে প্রথম ভাসানী, পরে শেখ মুজিব এবং তারপর শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর পরে আওয়ামী লীগকে সুসংবদ্ধ রাখা শেখ হাসিনা ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। ২০১৪-তে যা হওয়ার তা হয়েছে, তার জন্য একা আওয়ামী লীগকে দায়ী করা যাবে না। দায় নিতে হবে সব দলকে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র থাকবে কি থাকবে না, তা নির্ভর করে আওয়ামী লীগের দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ও ভূমিকার ওপর। সে ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে ইতিহাস তাকে দায়মুক্তি দেবে না।


সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক