অর্থনীতি নিয়ে 'নয়ছয়' বন্ধ হোক

তিন শ বছরের কিছু আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্ভবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার নির্ধারণ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ (টার্গেটিং), সরকারের ব্যাংক এবং ব্যাংকসমূহের ব্যাংক ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে কাজ করে অর্থনীতির ওঠানামা সামাল দিয়ে আসছে। সম্প্রতি ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) সুদের হার ‘নয় ও ছয়’ হবে ঘোষণা দেওয়ায় এবং সাম্প্রতিক কালে এই একই সংগঠনের আরও কিছু কার্যকলাপের ফলে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ও অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। ‘নয়ছয়’ একটি বাংলা বাগ্ধারা, যার অর্থ হলো অপচয়। কাকতালীয় হলেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিএবির মুখ থেকে আসা এই ‘নয় ও ছয়’-এর ঘোষণাটি আমাদের উদ্বিগ্ন করেছে।

আগে বাজার অর্থনীতিতে সরকারই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করত। নিয়ন্ত্রণের প্রধান উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ছিল প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করা, একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণ করা, জনস্বার্থ, বিশেষত ভোক্তা, গ্রাহক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করা। পরে দেখা গেল যে সরকার এ কাজ সুচারুভাবে করতে পারে না। রাজনৈতিক প্রভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব, অস্বচ্ছ সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া, স্বার্থের সংঘাত এর অন্যতম কারণ। ফলে বিশ্বব্যাপী স্বতন্ত্র নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার উদ্ভব ঘটে। যেমন ব্যাংকিং খাতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন প্রভৃতি। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেল যে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না বা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (১৯৮২) অর্থনীতিবিদ জর্জ স্টিগলার প্রথম ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখলে’র (রেগুলেটরি ক্যাপচার) ধারণাটি প্রবর্তন করেন। সাধারণভাবে এর অর্থ হলো নিয়ন্ত্রিত সংস্থাসমূহ কর্তৃক নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখল। আগেই বলেছি, জনস্বার্থ সুরক্ষার জন্যই নিয়ন্ত্রক সংস্থাসমূহ গঠন করা হয়ে থাকে। কিন্তু জনস্বার্থের পরিবর্তে যখন এসব সংস্থা যাদের নিয়ন্ত্রণ করার করার কথা ছিল, তাদের স্বার্থে কাজ করে, বলা হয়ে থাকে, তখনই নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখলের ঘটনা ঘটেছে। কয়েকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। যেমন ধরুন, আমাদের দেশে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) রয়েছে। এটা গঠন করা হয়েছে মূলত পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু তা না করে বিএসইসি যদি কেবল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কতিপয় কোম্পানি বা কোম্পানিগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণ করে, তাহলে বলা হবে যে নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখলের ঘটনা ঘটেছে।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা
উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে ব্যাংকমালিকেরা দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, এমনকি সংসদকেও প্রভাবিত করে তাঁদের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত আদায় করতে সমর্থ হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ সম্প্রতি ব্যাংক কোম্পানি আইনের এক সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁরা বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২ থেকে ৪ এবং পরিচালনা পর্ষদে সদস্যদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করতে সমর্থ হন। এরপর তাঁরা ক্যাশ রিজার্ভ রেসিও (সিআরআর) ১ এবং রেপো রেট শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হ্রাস ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বেসরকারি ব্যাংকে জমা করা অর্থের সীমা ২৫ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করতে সমর্থ হন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে তাঁরা ব্যাংক কোম্পানির জন্য করপোরেট আয়করের হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস করে নন-পাবলিকলি ও পাবলিকলি ট্রেডেড কোম্পানির জন্য যথাক্রমে ৪০ ও ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করাতে সমর্থ হন। সর্বশেষ তাঁরা ঋণের ওপর ৯ শতাংশ ও জমার ওপর ৬ শতাংশ সুদ নির্ধারণের প্রস্তাব করেছেন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বিএবির ঘোষণা অনুসরণ করেছে।

অসুবিধা কোথায়?
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধান সমস্যা হলো খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক খাতের করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট। ব্যাংক কোম্পানি আইনের এক সংশোধনীর মাধ্যমে বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে একই পরিবারের সদস্যসংখ্যা ২ থেকে ৪ এবং পরিচালনা পর্ষদে সদস্যদের মেয়াদ ৬ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করার ফলে করপোরেট ব্যবস্থাপনার সংকট আরও ঘনীভূত হবে। সিআরওর ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ, রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে হ্রাস ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বেসরকারি ব্যাংকে জমা করা অর্থের সীমা ২৫ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ প্রদান ও খেলাপি ঋণ উৎসাহিত হবে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক কোম্পানির জন্য আয়করের হার ৪৫ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হ্রাস করে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের ফলে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, ব্যাংকগুলোর মার্জারের এবং এই খাতে অতিপ্রয়োজনীয় সংস্কারের সম্ভাবনা ব্যাহত হবে। আর সুদের হার কী হবে, তা বিএবি নয়, বাজারই নির্ধারণ করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার মুদ্রানীতির মাধ্যমে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে পারে।

কেন এমন হলো?
দেশের মুদ্রানীতি নির্ধারণ, পরিচালনা ও ব্যাংকিং খাতকে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, উল্টো বিএবি তার সাম্প্রতিক কার্যকলাপের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে লেখার শুরুতে উল্লেখিত ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখল’ সম্পন্ন হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে তিনটি কারণে। আমাদের দেশে বিভিন্ন নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠিত হলেও এদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয় না। দ্বিতীয়ত, প্রায়ই এসব সংস্থায় অমেরুদণ্ডী ও জি হুজুর-টাইপের প্রধান নিয়োগ প্রদান করা হয়ে থাকে, যাঁরা নিরপেক্ষভাবে সংস্থা পরিচালনার পরিবর্তে ক্ষমতাসীন ও তাদের ঘনিষ্ঠ মহলের হুকুম তামিলে ব্যস্ত থাকেন। সর্বোপরি দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত সব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও সরকারপ্রধানের বিশ্বাসভাজনতা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক কালে এ ক্ষেত্রে আমরা ঘাটতি লক্ষ করছি। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। এতে আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা ছিল, তারাই উল্টো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছে। এখন তারা মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি সবকিছুই নির্ধারণ করছে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দখল ও তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিণতি আমরা জানি। ১৯৯৬ ও ২০১১ সালের শেয়ার মার্কেট বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থা দখল বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিস অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের ব্যর্থতা, যার ফলে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হন। বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যর্থতার কারণেই রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক দখল, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে; ২০১১ সালে তাদের সৃষ্ট অতিরিক্ত তারল্যের কারণে শেয়ার মার্কেটে ধস এবং নিয়ন্ত্রণে শৈথিল্যের কারণে খেলাপি ঋণের হার উদ্বেগজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনীতিতে নয়ছয় কেবল ব্যাংকিং খাতেই সীমাবদ্ধ নয়। সরকারি ব্যয়, রাজস্ব আয় ব্যবস্থাপনাসহ আরও অনেক ক্ষেত্রেই তা দৃশ্যমান এবং এগুলো ইতিমধ্যেই আমাদের অন্য সব খাতের অর্জনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

ব্যাংকমালিকদের সংগঠন বিএবির ওপরে উল্লেখিত কার্যক্রমগুলো জাতির জন্য অশনিসংকেত বয়ে এনেছে। সুদের হার কম হোক, সিঙ্গেল ডিজিট হোক, বিনিয়োগ বাড়ুক, এটা আমরা সবাই চাই। তবে তা নির্ধারণের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এটা বিএবির কাজ নয়। তাই ব্যাংকমালিকদের তাঁদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজকর্মের রাশ টেনে ধরতে হবে। ব্যাংকমালিকেরা নিশ্চয়ই ব্যাংকিং খাতসংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিতে পারেন, সরকারের কাছে তাঁদের দাবি জানাতে পারেন। কিন্তু এ খাতের বিষয়ে তাঁরা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্ররোচিত করতে পারেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব নিরপেক্ষ নিয়ন্ত্রক সংস্থার জন্য তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে এবং সরকারপ্রধানকে তা করতে হবে এখনই।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান: সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ