আল-কায়েদার বিপদবার্তা

আয়মান আল-জাওয়াহিরি
আয়মান আল-জাওয়াহিরি

আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরির নামে ইন্টারনেটে প্রচারিত অডিও বার্তাটি সত্যিই জাওয়াহিরির বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনারত বাংলাদেশি নিরাপত্তা বিশ্লেষক তাজ হাশমি। গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত এক উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে তিনি দাবি করেছেন, জাওয়াহিরির কণ্ঠস্বর তিনি চেনেন, তাঁর মিসরীয় উচ্চারণে বলা আরবি ভাষার বক্তৃতাটি তিনি ‘প্রায় নিশ্চিত’ভাবে শনাক্ত করতে পেরেছেন।
ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর তাঁর নেপথ্যের প্রধান ব্যক্তি মিসরীয় শল্যচিকিৎসক জাওয়াহিরি ছিন্নভিন্ন আল-কায়েদার হাল ধরেছেন, এমন খবর শোনা যায়। কিন্তু তিনি এখন কোন দেশে কী অবস্থায় আছেন, সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। ধারণা করা হয়, তিনি বহু বছর ধরে লুকিয়ে আছেন পাকিস্তান-আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী উপজাতীয় এলাকায়। লাদেন পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরের এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমেরিকান সেনাদের আক্রমণে নিহত হওয়ার পর তাঁর জীবনের শেষ কয়েক বছরের জীবনযাপন সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা যায়, তাতে দেখা যাচ্ছে মুঠোফোন, ইন্টারনেট, টেলিভিশন ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি থেকে লাদেন নিজেকে বিযুক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন শুধু চিঠি-চিরকুটের মাধ্যমে, যেগুলো সশরীরে বহন করতেন তাঁর অতি বিশ্বস্ত দুই সহোদর। সম্ভবত জাওয়াহিরিও এখন একই ধরনের প্রযুক্তিহীন, বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করছেন। (সিআইএ আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ অন্যত্র ড্রোন হামলা চালিয়ে যেসব জঙ্গিকে হত্যা করেছে, তাদের অনেকেই মারা পড়েছেন মুঠোফোন ব্যবহার করার কারণে) তবে বক্তৃতা অডিও বা ভিডিও টেপে ধারণ করে হাতে হাতে তা স্থানান্তর এবং অবশেষে কোনো একটি স্থান থেকে তা ইন্টারনেটে আপলোড করা তাঁর লোকজনের পক্ষে সম্ভব। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও ঝুঁকি থেকে যায়: আমেরিকান গোয়েন্দাদের পক্ষে প্রযুক্তিগতভাবে বের করা সম্ভব যে কম্পিউটার থেকে তা ইন্টারনেটে আপলোড করা হয়েছে তার ভৌগোলিক অবস্থান শনাক্ত করা।
তা সত্ত্বেও জাওয়াহিরির নামে অডিও বা ভিডিও বার্তা প্রচারের খবর প্রায়ই শোনা যায়। ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আমেরিকান সেনাদের আক্রমণে ওসামা বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত জাওয়াহিরির অন্তত ১২টি বার্তা প্রচারের খবর পাওয়া যায় (অধিকাংশই অডিও)। সর্বশেষ মিসরের সামরিক বাহিনী মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতা প্রেসিডেন্ট মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর তাঁর একটি অডিও বার্তা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়, যেটিতে তিনি মিসরীয় সামরিক বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেন। এর আগে সিরিয়া, ইরাক, সোমালিয়া, পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেও তাঁর অডিও বা ভিডিও বার্তা ইন্টারনেটে প্রচারিত হয়েছে।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশ নিয়ে জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি সম্পর্কে অধ্যাপক তাজ হাশমির নিশ্চয়তা বোধগম্য। কিন্তু বার্তাটি সত্যিই তাঁর কি না—এ প্রশ্নের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এর তাৎপর্য। সংগঠন হিসেবে আল-কায়েদা এখন আর আগের মতো সংগঠিত নয়, বরং একটি ভাবাদর্শ হিসেবেই এটি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামপন্থী জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। বাংলাদেশে ২০০৭ সালের পর থেকে জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যমান নয়। তার আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জামাআতুল মুজাহিদীন, হরকাতুল জিহাদ ইত্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর যেসব সক্রিয় তৎপরতা লক্ষ করা গেছে, সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারা আর সে রকম তৎপরতা প্রকাশ্যে চালাতে পারেনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রভাব ক্রমেই কমেছে। আমেরিকা ও ভারত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনে মহাজোট সরকারের কাছে বেশ সহযোগিতা পেয়ে এসেছে। ফলে এখন বাংলাদেশে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো চরম কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে।
কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে ইসলামি জঙ্গিবাদ বাংলাদেশে নির্মূল হয়ে গেছে। আল-কায়েদা, পাকিস্তান-আফগানিস্তানের তালেবান, লস্কর-ই-তাইয়েবা কিংবা ভারতভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের গোপন যোগাযোগ হয়তো এখন আর আগের মতো নেই; কিন্তু স্থানীয়ভাবে তাদের কর্মকাণ্ড যে সচল রয়েছে, অন্তত তারা যে জঙ্গি বা জিহাদি ভাবাদর্শ প্রচারের কাজে নিয়োজিত আছে, তার কিছু কিছু আলামত মাঝেমধ্যেই পাওয়া যায়। শাহবাগ আন্দোলনের সময় ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনার মধ্য দিয়েও ইসলামি জঙ্গি ভাবাদর্শ নিয়ে কর্মরত কিছু কিছু গোষ্ঠীর অস্তিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া ইন্টারনেটের বিভিন্ন ব্লগ বা সাইট থেকেও এটা বোঝা যায় যে ইসলামি জঙ্গিবাদী তৎপরতার ভাবাদর্শগত ক্ষেত্রটি এ দেশে নেহাত ছোট নয়। জাওয়াহিরির অডিও বার্তাটি ইন্টারনেটে প্রচারের দায়ে রাসেল বিন সাত্তার নামে যে তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ভাষ্য অনুযায়ী, তাঁর কাছ থেকেও বেশ কিছু পরিমাণ জিহাদি প্রচারণা উপকরণ জব্দ করা হয়েছে। আর জাওয়াহিরির কথিত অডিও বার্তাটি, যার শিরোনাম ‘বাংলাদেশ: ম্যাসাকার বিহাইন্ড আ ওয়াল সাইলেন্স’, তার বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, জাওয়াহিরি বাংলাদেশে ‘ইসলামবিরোধী’দের বিরুদ্ধে ‘ইন্তিফাদা’ বা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন যাদের প্রতি, তারা এ দেশে বিলক্ষণ রয়ে গেছে। অডিও বার্তার তাৎপর্য এটাই যে সেসব জঙ্গিগোষ্ঠী এককাট্টা সুসংগঠিত না হয়েও আয়মান আল-জাওয়াহিরির আহ্বানে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিচ্ছিন্নভাবেও সক্রিয়তা দেখাতে পারে।
তবে বাংলাদেশ সরকার যেমনটি বলেছে, তারা এই বার্তায় উদ্বিগ্ন হয়নি, তা যদি এ কারণে হয় যে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট মাত্রায় সতর্ক আছে, কেবল তাহলেই স্বস্তি বোধ করা যায়। অন্যথায় এই উদ্বেগহীনতা মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারকে ইসলামবিরোধী, নাস্তিক ইত্যাদি বলে প্রচার করার প্রবল তৎপরতা ইন্টারনেট জগতে লক্ষ করা যায়। শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে ইসলামি জঙ্গিদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু অনেক আগে থেকেই। উপরন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দণ্ড কার্যকর করে পুরো প্রক্রিয়াটি নিষ্পন্ন করার কাজ এখনো বাকি রয়ে গেছে।
কিন্তু জাওয়াহিরির এই অডিও বার্তা নিয়ে সরকারের লোকজনের কণ্ঠে যেসব রাজনৈতিক কথাবার্তা উচ্চারিত হচ্ছে, বিশেষত বিএনপি, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে আল-কায়েদা বা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে যেসব কথা বলা হচ্ছে, তার ফলে সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টায় যেসব কথা বলা হচ্ছে, তাতে বিএনপির প্রতিও মানুষের সন্দেহ বাড়তে পারে। আল-কায়েদা কিংবা ইসলামি জঙ্গিবাদ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতি করতে চাইলে যে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, তাতে লাভ হবে কেবল জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোরই।
আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলো অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির দ্বারাও ব্যবহূত হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় সংস্থার গোপন সহযোগিতায় ইসলামি জঙ্গিদের তৎপরতা বৃদ্ধির বিষয়টি ইতিমধ্যে সুবিদিত। এমনকি ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কোনো কোনো কর্মকর্তা ‘হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ’ (হুজিবি) নামে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সহযোগিতা করেছেন, এমনকি রাজনৈতিক বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন—এমন তথ্য পাওয়া যায় আমেরিকান কূটনৈতিক দলিলে। জরুরি অবস্থায় যখন সব ধরনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই সময় জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে রাজনৈতিক দল (ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি—আইডিপি) গঠনের ঘোষণা দিতে পেরেছিল হুজিবি।
এখন সে অবস্থা নেই বলেই মনে হয়। শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে গত পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতা দৃশ্যমান না হওয়ার একটি বড় কারণ হয়তো এটাও। এ দেশে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মতো সামাজিক সমর্থন ইসলামি জঙ্গিরা পায় না। তাদের পালিয়ে থাকতে হয় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকেই নয়, সমাজের কাছ থেকেও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোনো মহল তাদের ব্যবহার করতে না চাইলে এবং রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্থার মধ্যকার কোনো অংশ গোপনে তাদের মদদ না দিলে এ দেশে জঙ্গিদের পক্ষে বড় ধরনের কিছু করা অত্যন্ত কঠিন।

মশিউল আলম: সাংবাদিক।