জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বৈত ভর্তিতে তুঘলকি

জয় বাবু মিথুন ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে কারমাইকেল কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে নতুন করে ভর্তি হয়েছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। আগের ভর্তি বাতিল করার জন্য ১ হাজার ২০ টাকা বিভাগে জমা দিয়েছেন। লিখিত আবেদনও করেছিলেন বাতিলের জন্য।

এক বছর লেখাপড়া করার পর ফরম পূরণের সময় জয় বাবু মিথুন জানতে পারলেন, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ তাঁর ভর্তি বাতিল করেনি। এ কারণে তাঁর রেজিস্ট্রেশন কার্ড আসেনি। তাঁর রেজিস্ট্রেশন কার্ড আসবে যদি তিনি নতুন করে ভর্তি বাতিলের ৭৫০ টাকা এবং জরিমানা হিসেবে ৮ হাজার ২৪৬ টাকা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রদান করেন। জয় বাবু মিথুনের বাবা মেঘনা মোহন্ত পেশায় দিনমজুর। তাঁর প‌ক্ষে এত টাকা দেওয়া অসম্ভব। ফলে ২৫ জুন জরিমানা দেওয়ার শেষ তারিখ থাকলেও মিথুনের পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব হয়নি। যদি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিনা অপরাধে শাস্তির বিধান প্রত্যাহার না করে, তাহলে তাঁর শিক্ষাজীবনের সমাপ্তি ঘটবে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারে দ্বৈত ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ৭৭০টির অধিক কলেজে সম্মান কোর্স চালু আছে। অধিভুক্ত কলেজের সংখ্যা ২ হাজার ২৪৯। এ কলেজগুলোয় প্রথম বছর অনেকেই সম্মান কোর্সে সুযোগ না পেয়ে ডিগ্রি পাস কোর্সে ভর্তি হন। আবার অনেকে পছন্দমতো বিষয় না পেলে একটি বিষয়ে ভর্তি হয়ে থাকেন। পরের বছর আবার নতুন করে ভালো বিষয় পেলে নতুন বিষয়ে ভর্তি হন। এ প্রক্রিয়া যে শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য তা নয়, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একই চিত্র।

নিয়ম হচ্ছে, যখন কেউ নতুন করে ভর্তি হবেন, তিনি অবশ্যই তাঁর পুরোনো ভর্তি বাতিল করবেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয় একজন শিক্ষার্থীকে একটি মাত্র নিবন্ধন নম্বর দেবে—এটাই স্বাভাবিক। ভর্তির পর যাতে একজন শিক্ষার্থী দুই প্রতিষ্ঠানে কিংবা দুই বিষয়ে ভর্তি হতে না পারেন, সে জন্য তাঁদের মূল সনদপত্র ভর্তিকৃত বিভাগে সংরক্ষণ করা হয়। যে কারণে একজন শিক্ষার্থীর প‌ক্ষে একসঙ্গে দুই বিষয়ে কিংবা দুই শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি বাতিল না করে তাঁর মূল সনদপত্র গ্রহণ করতে চান, তাঁকেও এই শর্তেই মূল সনদ দেওয়া হয় যে ১৫ দিনের মধ্যে কাগজ ফেরত না দিলে তাঁর ভর্তি বাতিল করা হবে। মূল সনদপত্র দেওয়ার সময় জামানত হিসেবে এক হাজার টাকা গ্রহণ করা হয়। যদি ওই শিক্ষার্থী কাগজ ফেরত না দেন, তাহলে ওই এক হাজার টাকা থেকে ৭৫০ ফি দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি বাতিল করা হয়।

একজন শিক্ষার্থী এক হাজার টাকা দিয়ে যখন কাগজপত্র তুলে নেন আর জমা দেন না, তখন তিনি জানেন যে তাঁর ভর্তি বাতিল হয়েছে। কারণ, ভর্তি বাতিলের ফি তিনি প্রদান করেছেন। এই প্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর জানার কোনো উপায় নেই যে তাঁর ভর্তি বাতিল হয়েছে কি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ রকম কোনো ব্যবস্থা রাখেনি।

২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী ডিগ্রি পাস কোর্স থেকে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হয়েছেন। আবার অনেকই কলেজ কিংবা বিষয় পরিবর্তন করে নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়েছেন। তাঁরা ভর্তি বাতিল করার জন্য ফি প্রদান সাপেক্ষে মূল সনদ গ্রহণও করেছেন। ভর্তি বাতিলপ্রক্রিয়ায় একজন শিক্ষার্থীর ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কোনো ত্রুটি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট অধিভুক্ত কলেজ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। কলেজ কর্তৃপক্ষ ভর্তি বাতিল ব্যতিরেকে মূল কাগজ দিতে পারে না।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে গত বছর ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সমস্ত তথ্য আগে থেকেই ছিল। তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন একজন শিক্ষার্থীর দুবার ভর্তি গ্রহণ করল। ডিজিটাল পদ্ধতিতে এই তথ্য জানার জন্য কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজনও ছিল না। এটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের খামখেয়ালিপনা।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দ্বৈত ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আগে কখনোই কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে সংশ্লিষ্ট কলেজগুলো এ বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইনগতভাবে ঠিক অবস্থান নিয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর আগের ভর্তি/রেজিস্ট্রেশন বাতিল হবে তারপর দ্বিতীয় রেজিস্ট্রেশন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে দুটি ক্ষেত্রে। প্রথমত প্রশ্ন হচ্ছে, দায় কেন শিক্ষার্থীদের? দ্বিতীয় প্রশ্ন, ভর্তি বাতিল করতে কি ৮ হাজার ২০০ টাকার প্রয়োজন আছে?

ভর্তি বাতিল ফি ৭৫০ টাকা হলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে এক হাজার টাকা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বরং বলা উচিত ছিল, যাদের থেকে এক হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে, তাঁদের রসিদ মূলে ২৫০ টাকা ফেরত দেওয়া হোক। তা না করে তাঁদের ওপর জরিমানার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আমরা সারা জীবন দেখে এসেছি, মূল টাকার চেয়ে জরিমানা কম। যেমন যথাসময়ে ভর্তি কিংবা ফরম পূরণ করতে না পারলে যে জরিমানা নির্ধারণ করা হয়, তা সব সময়ই মূল প্রদেয়র চেয়ে অনেক কম। এটাই রীতি। কিন্তু যে ফি মাত্র ৭ ৫০ টাকা, সেই ফির স্থলে ৮ হাজার ২০০ টাকা জরিমানা লঘু পাপে গুরু দণ্ডের শামিল। বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়েও কোনো দিন এত আনুপাতিক হারে বেশি জরিমানা করেছে বলে মনে হয় না।

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক।
[email protected]