শিক্ষকেরা আবার অনশনে কেন?
মনে পড়ে? ঈদের দিন সকালে নামাজ আদায়ের পর প্রেসক্লাবের সামনে ভুখা মিছিল করে নিজেদের দুর্দশার কথা জানান দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এমপিওভুক্তির দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকেরা। ঈদের ঠিক পরপর ২০ জুন খবরের কাগজ থেকে আমরা জানতে পারলাম, এমপিওভুক্তির কাজ শুরু করেছে সরকার। একই দিনে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির কাজের জন্য একটা বাছাই কমিটি এবং অনলাইনে আবেদন গ্রহণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য আরেকটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারপরও ২৩ জুন থেকে প্রথমে দুদিন প্রতীকী অনশন ও তারপর ২৫ জুন থেকে এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকেরা আমরণ অনশন শুরু করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, সরকার এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করার পরও শিক্ষকেরা নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরণ অনশনের মতো একটা কঠোর কর্মসূচি নিলেন কেন? রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, না খেয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকার পেছনে কী আনন্দ থাকতে পারে?
এ ধরনের নতুন করে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করার অর্থ হচ্ছে, যেসব স্কুল এরই মধ্যে এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে, সেই স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ৫ হাজার ২৪২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নতুন করে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। ধরুন, আপনারা দুই ভাই এসএসসি পরীক্ষা দিলেন। আপনার এক ‘মধ্যম আয়ের দেশের’ চাচা, যাঁর ‘কোনো দারিদ্র্য’ নেই বা কোনো ‘অভাব’ নেই, প্রতিশ্রুতি দিলেন এসএসসি পাস করার পর আপনাদের দুই ভাইকে দুটি সাইকেল কিনে দেওয়া হবে। আপনারা দুই ভাই সার্টিফিকেট উঠিয়ে আপনার মধ্যম আয়ের চাচার কাছে গিয়ে সার্টিফিকেট দেখালেন। উনি বললেন, সার্টিফিকেট দিয়ে কাজ হবে না, বোঝাতে হবে ‘তোমরা’ সার্টিফিকেট পাওয়ার যোগ্য। এখন আপনারা দুই ভাই জানেন না নতুন করে কী পরীক্ষা নেওয়া হবে। চাচার মনে আসলে কী আছে? ওনার ঘাড় টিপে দিতে হবে, নাকি পা মালিশ করে দিতে হবে? নাকি অন্য কিছু? চাচা বললেন, অনলাইনে সব তথ্য দাও। আপনি কোন পরীক্ষায় কী লিখে পাস করেছিলেন, সেগুলো এখন নতুন করে পরীক্ষা দেবেন। যিনি পরীক্ষা নিতেন, তিনি নতুন একজন নিয়োগপ্রাপ্ত লোক। আপনি এর আগে কীভাবে পড়েছিলেন, কী সিলেবাস ছিল, প্রশ্ন কেমন ছিল, তা উনি জানেন না। কিন্তু এখন নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে। আপনার জন্য সাইকেল খুব জরুরি না হলে আপনার মনে হতে পারে, এই পরীক্ষা দেওয়ার চেয়ে দুই মাস টিউশনি করে নিজের টাকায় একটা সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনে ফেলাই ভালো। খুবই সম্ভাবনা আছে এমন একটি সমাধানের পথ বেছে নেওয়ার এবং চাচার ওপর রাগ হয়ে কোনো দিনই ওনার কাছে না যাওয়ার। কিন্তু শিক্ষকদের কাছে এমপিও নিতান্তই একটি সাইকেল নয়; এটা তাঁদের কাছে জীবন-মরণের ব্যাপার। তাঁদের নিজেদের অস্তিত্ব, পরিবার নিয়ে, জীবিকার পথ বাঁচিয়ে রেখে টিকে থাকার একটি প্রশ্ন।
গত বছর ২৬ ডিসেম্বর থেকে এমপিও যোগ্যতা অর্জনকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্মচারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার কর্মসূচি শুরু করেন। টানা এই অবস্থান ও অনশনের একপর্যায়ে ৫ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে তাঁর তৎকালীন একান্ত সচিব সাজ্জাদুল হাসান গিয়ে আশ্বাস দেওয়ায় শিক্ষকেরা কর্মসূচি স্থগিত করেন। এরপর সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, আসন্ন অর্থবছরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় স্পষ্টভাবে এই বিষয়ে কোনো বক্তব্য না দেওয়ায় নিরুপায় হয়ে শিক্ষকেরা আবার আন্দোলনে নামেন। ১০ জুন শিক্ষকেরা প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করলে তাঁদের পুলিশ বাধা দেয়। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, এরপরও সুযোগ আছে এবং তিনি অর্থমন্ত্রীর কথা রাখবেন এবং সুযোগ করে দেবেন। এরপর প্রথম আলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র মারফত জানিয়েছে, নতুন নীতিমালা অনুযায়ী হাজার খানেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হবে। সফটওয়্যার তৈরির পর শিগগিরই অনলাইনে ‘এমপিও প্রত্যাশী’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আবেদন গ্রহণ করা হবে।
একটু লক্ষ করুন, দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে ‘এমপিও স্বীকৃতপ্রাপ্ত’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এক দিনের বৈঠকের কৃপায় ‘এমপিও প্রত্যাশী’ স্তরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দীর্ঘদিন চর্চা করে আসা স্বীকৃতির প্রক্রিয়া এক দিনে নতুন কমিটির মাধ্যমে নাকচ করে নতুনভাবে আবেদন করতে বাধ্য করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জনের জন্য ৫ হাজার ২৪২টি প্রতিষ্ঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রদত্ত শর্ত পূরণ করে এর আগে আবেদন করেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইনভেস্টিগেটররা সশরীরে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে সেই স্কুলগুলোকে এমপিও যোগ্যতার স্বীকৃতি দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রথমে পাঁচ বছরের স্বীকৃতি অর্জন করে এবং পরে সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে পুনর্মূল্যায়নের পর সেই স্বীকৃতিপত্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থাৎ তাদের একবার না, বারবারই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মূল্যায়নের ভিত্তিতে যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এর মধ্যে সরকারের কাছ থেকে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ল্যাব, ক্লাসরুম নির্মাণসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বরাদ্দও পেয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকার তাদের যে বরাদ্দ দেয়, তা তাদের সাফল্য ও অর্জনের কারণেই দিয়ে থাকে। কিন্তু শুধু শিক্ষকদের বরাদ্দের বেলায় তাহলে কেন নতুন করে যোগ্যতা প্রমাণ করতে হবে? এর অর্থ কি শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেই নিজের নেওয়া পরীক্ষার ওপর আস্থাশীল নয়? নাকি কম্পিউটার ল্যাব বা শ্রেণিকক্ষ মেরামতে ঠিকাদার ও টেন্ডারবাজদের কাছ থেকে যত বেশি সুবিধা আদায় করা যায়, তত সুবিধা আদায় করা যায় না শিক্ষকদের কাছ থেকে?
যদি ৫ হাজার ২৪২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র হাজারখানেক প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘অলিখিত’ ও ‘অপ্রকাশিত’ বরাদ্দ সব সমাধান করে দেয়, তাহলে এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন কেন? কারণ, ওনারা বুঝে গেছেন, সেই সাইকেল-আকাঙ্ক্ষী দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাইকে সাইকেল দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে আংশিক দেওয়ার জন্য নতুন শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের মূল পাঠ্যদানের কাজ রেখে যেন নতুন ইঁদুরদৌড়ে অংশগ্রহণ করে। এক ভাই অপর ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে জেনে যাক অধ্যবসায় ও গুণাবলি ঊর্ধ্বে আনুগত্য।
সকাল-বিকেল ক্লাস নিয়ে, সন্ধ্যায় অন্য চাকরি বা ব্যবসায় সময় দিয়ে আনুগত্যের রাজনীতি করার সময় এই শিক্ষকদের তেমন একটা নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে যে নতুন মূল্যায়নকারী পাঠানো হবে, তাদের সন্তুষ্ট করার মতো আর্থিক সামর্থ্যও তাঁদের নেই। তাঁদের এখন হারানোর মতো একটা দেহ আছে। আর তা নিয়েই তাঁরা আমরণ অনশনে বসেছেন।
মোশাহিদা সুলতানা: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়