বৈষম্য দূরের আশা জোগাচ্ছে না বাজেট

পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের বৈষম্য ছিল ভয়াবহ। যেসব কারণে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম বৈষম্য দূরীকরণ। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে বৈষম্যমূলক উন্নয়ন। বর্তমানে এই বৈষম্য যে মাত্রায় পৌঁছেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এত বৈষম্য আর কখনোই ছিল না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে এখন বৈষম্যের হার প্রায় ৬৯ শতাংশ। এখানে দেখা যায়, নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ আর কুড়িগ্রামে দারিদ্র্যের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈষম্যের হার ছিল সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ। সেই পরিসংখ্যানে কুড়িগ্রামে দারিদ্র্য ছিল ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ আর কুষ্টিয়ায় ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

ছোট্ট একটি দেশ। তারপরও আমরা বৈষম্য দূর করতে পারিনি। এর একমাত্র কারণ শাসকগোষ্ঠী কখনো বৈষম্য দূর করতেই চায়নি। ২০১০ সালে বাংলাদেশে গড় দারিদ্র্যের হার ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৬ সালে তা ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। সারা দেশে যখন প্রায় ৭ শতাংশ গড় দারিদ্র্য কমেছে, তখন দিনাজপুর জেলায় দারিদ্র্য বেড়েছে ১৭ শতাংশ। তাহলে বাংলাদেশে যে রাজনীতিবিদেরা উন্নয়নের কথা বলেন, তাঁরা তো বলেন না এ উন্নয়ন একপেশে!

বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব জেলার নাম কুড়িগ্রাম। এ বছরেই সবচেয়ে গরিব তা নয়। কুড়িগ্রাম জেলার শাপলার মোড় এলাকার ষাটোর্ধ্ব আবদুস সালামের সঙ্গে কথা হয় কুড়িগ্রামের দারিদ্র্য নিয়ে। তিনি বলেন, ‘বোধ হইচে থাকি শুনি কুড়িগ্রাম সবচেয়ে গরিব। মরা পর্যন্ত মনে হয় আর ভালো কথা শুইনবার নই।’

১৮ জুন কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে উন্নয়নবৈষম্য নিয়ে একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কুড়িগ্রামের সচেতন নাগরিক সমাজ ছিল এর আয়োজক। অনেকেই এ অঞ্চলের সাংসদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক জালাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের জনপ্রতিনিধিগণ জানেনই না সরকারের কাছে এ অঞ্চলের জন্য কী চাইতে হবে। যত দিন আমরা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে ভুল করব, তত দিন আমাদের সমস্যা দূর হবে না।’

কুড়িগ্রাম গরিব—এ কথা বলার স্বাধীনতা কোনোকালেই ছিল না, গোলটেবিল বৈঠকে এমন কথা অনেকেই বলছিলেন। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আহসান হাবীব, গণকমিটির প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ হাসান, সদস্য দিল্লুর রহমান, জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি সামিউল হক—সবাই একই কথা বললেন। সামিউল হক তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি কুড়িগ্রামের যাত্রাপুরে না খেয়ে মানুষ মারা যাওয়ার কথা লেখায় পাকিস্তান সরকার তাঁর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ছয় মাস তিনি পলাতক ছিলেন। গণকমিটির দিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা কুড়িগ্রামের উন্নয়ন-বৈষম্য নিয়ে একটি জনসভা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাদের করতে দেওয়া হয়নি।’

দেশে উন্নয়নবৈষম্য থাকলে তা বলা যাবে না এমন তো কোনো কারণ দেখি না। ব্যাধি স্বীকার না করলে চিকিৎসাপত্র হবে কীভাবে? যে পরিসংখ্যান ধরে উন্নয়নবৈষম্য দূর করার কথা বলা হচ্ছে তা তো সরকারেরই করা। ঢাকায় কুড়িগ্রাম জেলা সমিতির মহাসচিব সাইদুল আবেদীন যা বলেছেন, সেটি ভাবার বিষয়। তিনি বলছেন, ‘সারা দেশে শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করার জন্য দেশে কোনো না-কোনো এলাকাকে গরিব করে রাখতে হবে। সেই এলাকা হিসেবে এ অঞ্চলকে বেছে নেওয়া হয়েছে কি না কে জানে? এ অঞ্চল কি হবে শ্রমিক উৎপাদনের জন্য?’

প্রতিবছর উন্নয়নবৈষম্য বেড়েই চলেছে। অথচ এ বৈষম্য দূর করতে সরকারি পর্যায়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। এর মধ্যে কোনো কোনো জেলা এবং বিভাগ সব সময়ই গরিব। অথচ এই বৈষম্য দূর করতে সরকারের শুধু সদিচ্ছাই যথেষ্ট।

২০১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার মধ্যে রংপুর বিভাগের তিনটি জেলা—রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা। ২০১৬ সালে সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলার মধ্যে ৫টি জেলা এখন রংপুর বিভাগের। লালমনিরহাট ও দিনাজপুর নতুন করে ঢুকেছে। রংপুরে অপ্রতুল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা, শিল্পকারখানার স্বল্পতা, বন্যা প্রতিরোধে উদাসীনতা এ অঞ্চলকে প্রতিদিন পিছিয়ে দিচ্ছে। যেভাবে উন্নয়নবৈষম্য বেড়ে চলেছে, তাতে করে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভ বাড়ছে। সরকারের বিষয়টি উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। তার জন্য বাজেটেই ঘোষণা থাকতে হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ও রিভারাইন পিপলের পরিচালক