ফুটবল উন্মাদনাকে কাজে লাগাচ্ছে ক্রেমলিন

রাশিয়ার ১১টি শহর বিশ্বকাপ ফুটবলের আতিথ্যকর্তার ভূমিকায় থেকে উৎসবকে মাতিয়ে রেখেছে
রাশিয়ার ১১টি শহর বিশ্বকাপ ফুটবলের আতিথ্যকর্তার ভূমিকায় থেকে উৎসবকে মাতিয়ে রেখেছে

বিশ্বকাপ এখন পুরোদমে চাঙা। রাশিয়ার মাটিতে এমন উৎসবমুখরতা কয়েক প্রজন্ম কখনো দেখেনি। কার্নিভ্যালের আবহে মুড়েছে ১১টি শহর। কি দিন কি রাত, সেখানকার রাস্তাঘাট এখন লোকজনে গমগম করছে। রাশিয়ার ফুটবল দলের পাঁড় সমর্থকেরা হয়তো প্রতিপক্ষের দিকে ভোদকার বোতল ছুড়ে মারছে।

প্রত্যন্ত সারানস্ক প্রদেশের স্থানীয় বাসিন্দারা জাপান, কলম্বিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে আসা এমন সব অতিথিকে বাড়িতে থাকার জায়গা করে দিচ্ছেন, যাঁদের আর কোনো দিনই হয়তো সারানস্কে আসার দরকার হবে না। সাদাপোশাকধারী পুলিশ কর্মকর্তারা হাসিমুখে আগত ফুটবলভক্তদের নানা স্থানে আসা-যাওয়ার পথ বাতলে দিচ্ছেন। উৎসবমুখর পরিবেশে অনেকে বাড়াবাড়ি রকম উন্মাদনা করলেও পুলিশ সদস্যরা মোটেও বিরক্ত হচ্ছেন না। আন্তরিকভাবে তাঁরা পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।

অথচ মাত্র কয়েক মাস আগে এই পুলিশ কর্মকর্তারাই সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের লাঠিপেটা করে নাস্তানাবুদ করেছেন এবং বলা যায় এক মাস পরই তাঁরা নিশ্চিতভাবে আগের চেহারায় ফিরে যাবেন। কিন্তু এখন ‘পার্টি টাইম’ চলছে, তাই কোনো কিছুতে এখন বাধা নেই। টুকটাক অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা এখন ক্ষমার চোখে দেখছেন তাঁরা।

বিশ্বকাপের সুবাদে দেশজুড়ে যে উৎসবমুখর পরিবেশ চলছে, তার প্রভাব পড়েছে রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমেও। সেখানে অতিরিক্ত নেতিবাচক খবর সম্প্রচার করা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের আঞ্চলিক শাখাগুলোকে অপরাধের তথ্য আপাতত প্রকাশ না করতে নির্দেশ দিয়েছে।

বিশ্বকাপ চলাকালে রুশ জনগণের আনন্দ ধরে রাখার বিষয়ে সরকারের এই বিশেষ যত্নশীলতা যে এমনি এমনি, তা ভাবার কোনো কারণ নেই। আসল ব্যাপার হলো সরকার শিগগিরই জনগণকে খেপিয়ে তোলার মতো আরেক দফা সংস্কার এবং নিরাপত্তা অভিযানের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। এসব উদ্যোগ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতেই উৎসবের এই মুহূর্তগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে।

বিশ্বকাপের উন্মাদনার মধ্যে ক্রেমলিন তার সবচেয়ে অজনপ্রিয় সংস্কারকাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি হলো পেনশনের বয়সসীমা বাড়ানো। বর্তমানে রাশিয়ায় নারীদের অবসরের বয়সসীমা ৫৫ বছর। এই সীমাকে ৬৩ বছরে নিতে চায় সরকার। অন্যদিকে পুরুষদের বিদ্যমান অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর। এটিকে ৬৫ বছরে নেওয়া হবে। সরকারের এই সিদ্ধান্ত রুশ নাগরিকেরা ভালো চেখে দেখছেন না। তাঁরা আগেভাগে অবসরে যাওয়ার পক্ষে।

রাশিয়ার ৮৩টি অঞ্চলের ৫১টিতেই পুরুষদের গড় আয়ু ৬৫ বছরের নিচে। নতুন আইন কার্যকর হলে গড় পুরুষ নাগরিকেরা অবসরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। তার আগেই তাঁদের মৃত্যু হবে। ভ্লাদিমির পুতিন ভালো করেই জানেন, এই সংস্কার জনগণ পছন্দ করবে না। ২০০৫ সালে তিনি নিজেও বলেছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থাকাকালে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কখনোই নেওয়া হবে না।

কিন্তু রাশিয়ার অর্থনীতি ভালো যাচ্ছে না (যেমন গত মাসেও রাশিয়ার মোট আয় ১০ শতাংশ কমে গেছে) এবং সরকারের অর্থ দরকার হয়ে পড়েছে। রাশিয়া আশা করছে, পেনশন খাতে এই সংস্কার আনা হলে ২০২৪ সাল থেকে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন রুবল (দেড় হাজার কোটি ডলার) বাঁচানো যাবে।

এ রকম একটি সুবিধা আদায় করে নেওয়ার জন্য ক্রেমলিন বিশ্বকাপের মতো একটি মওকাকে কাজে লাগাবে না কেন? এই সংস্কারের পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে রুশ সরকার ইউরোপের বিভিন্ন দেশের উদাহরণকে তুলে ধরছে। তবে অনেকেই এ যুক্তি মানছেন না। তাঁরা বলছেন, ইউরোপের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার তুলনা করা অযৌক্তিক।

রাশিয়ায় আয়ের বৈষম্য ও দুর্নীতির প্রকোপ বাড়ছে এবং এ দুই বিষয় এক হয়ে অনেকের জীবনমানকে চরম হীন অবস্থায় নামিয়ে এনেছে। রাশিয়ায় বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে ২ কোটি ২০ লাখ লোক; অর্থাৎ তার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ। এই সংখ্যা যেমন একদিকে বাড়ছে, অন্যদিকে শতকোটিপতির সংখ্যাও বাড়ছে। রাশিয়ায় ৪৬ হাজার কোটি থেকে ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের মালিকের সংখ্যা এই অল্প কিছুদিন আগ পর্যন্তও ছিল ৯৬ জন। এখন তাদের সংখ্যা ১০৬ জন।

হ্যাঁ, এটা ঠিক যে সংস্কার হলে পেনশন খাত থেকে সরকার বছরে এক ট্রিলিয়ন রুবল বাঁচাতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে সরকারের নানা কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে দুই ট্রিলিয়ন রুবল নষ্ট হচ্ছে এবং এই দুর্নীতি ঠেকাতে সরকারের তেমন কোনো পরিকল্পনাও নেই। বিশ্বকাপ আয়োজনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকার যে শুধু তার অজনপ্রিয় সংস্কারকাজগুলো এগিয়ে নিতে চায়, তা নয়। এই সুযোগে সরকার তার নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও সংহত করছে। ১৫ জুনের আগে নিরাপত্তাকর্মীরা বেশ কিছু অভিযান চালিয়ে বিরোধীদের ধরপাকড় করেছেন। বিশ্বকাপের উন্মাদনায় সেই ধরপাকড়ের বিরোধিতাকারীদের স্বর চাপা পড়ে গেছে।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, আন্দোলনকারীদের ধরে নিয়ে গিয়ে এফএসবি সদস্যরা এমন অমানুষিক নির্যাতন করেন, যার কারণে নির্দোষ লোকও দোষ স্বীকার করতে বাধ্য হয়। সরকারবিরোধীদের বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। না ঘুমিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। বেধড়ক পেটানো হয়। চাপা জায়গায় হাতকড়া পরিয়ে দীর্ঘ সময় অনড় দাঁড়িয়ে রাখা হয়। এ রকম নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়।

রাশিয়ার ১১টি শহর বিশ্বকাপ ফুটবলের আতিথ্যকর্তার ভূমিকায় থেকে উৎসবকে মাতিয়ে রেখেছে। কিন্তু গ্রীষ্মকালীন কার্নিভ্যালের এত হইচইয়ের আড়ালে যে ‘শীত’ রুশ নাগরিকদের পার করতে হচ্ছে, তা বাইরে থেকে বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তবে সবাই যে উন্মাদনায় ডুবে গেছে, তাও ঠিক নয়। অসংখ্য রুশ নাগরিক এই উৎসব-উদ্দীপনাকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। এর সঙ্গে একাত্ম হতে পারছেন না। এতে চমকে ওঠার মতো কিছু নেইও।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

রোমান দোবরোখোতোভ অনুসন্ধানী অনলাইন পত্রিকা দ্য ইনসাইডার-এর প্রধান সম্পাদক