ওহুদের শহীদ দিবস

ইসলাম শান্তি, সম্প্রীতি, মৈত্রী, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য; ইসলাম মানবতার জন্য; ইসলাম সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের জন্য। ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আওয়াল মাসে আল্লাহর নির্দেশে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরত করে মদিনায় যান। নিরীহ শান্তিকামী মদিনাবাসী এতে খুশি হন। মদিনায় স্থিতিশীল সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। পঞ্চম হিজরির রমজান মাস শেষে মক্কার কুরাইশরা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার দূরে এসে মদিনা আক্রমণে অভিযান পরিচালনা করে। মদিনা থেকে তিন মাইল উত্তরে পঞ্চম হিজরি সনের ১৫ শাওয়াল শনিবার ওহুদ নামক পাহাড়ে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাই এটি ওহুদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। কুরাইশদের ছিল ৩ হাজার সৈন্যের বিশাল বাহিনী, ৭০০ বর্মধারী, ২০০ অশ্বারোহী, উষ্ট্রারোহী ও রসদবাহী সেনাদল। ঈদুল ফিতরের ১৩ দিন পর তারা মদিনার উপকণ্ঠে ওহুদ পাহাড়ের অপর প্রান্তে অবস্থান নেয়।
১৪ শাওয়াল শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রিয় নবী (সা.) সাহাবাদের পরামর্শে নগরের বাইরে এসে আক্রমণ প্রতিহত করে নগর সুরক্ষার সিদ্ধান্ত নেন। এদিন আসরের নামাজের পর সাহাবিরা মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত হন। সাহাবিদের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার; এতে মাত্র ২ জন ঘোড়সওয়ার, ৭০ জন বর্মধারী, ৪০ জন তিরন্দাজ, বাকি সবাই পদাতিক। পথে বনু খাজরাজ গোত্রীয় মুনাফিক আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নগর অভ্যন্তরে থেকে আত্মরক্ষার নামে ৩০০ সেনা নিয়ে কেটে পড়ে, থাকল মাত্র ৭০০ মুজাহিদ।
১৫ শাওয়াল শনিবার সকালে মুসলিম কাফেলা মদিনা থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপনীত হয়। রাসুলে আকরাম (সা.) এই যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম শিবিরের বাঁ পাশে পাহাড়ে একটি সুড়ঙ্গপথ ছিল। নবীজি (সা.) ৫০ জনের একদল তিরন্দাজকে এই গিরিপথের পাহারায় নিযুক্ত করে বলেন, ‘আমাদের জয়-পরাজয় যা-ই হোক, তোমরা এ স্থান ত্যাগ করবে না।’
যুদ্ধের শুরুতে কুরাইশদের পক্ষ থেকে তালহা আক্রমণে এলে হজরত আলী (রা.) তার মোকাবিলা করেন। তালহার ভাই ওসমান আক্রমণ করলে হজরত হামজা (রা.) তা প্রতিহত করেন। কুরাইশরা তাদের বীরদের পরাজয়ে বিচলিত হয়ে সংঘবদ্ধ আক্রমণ করল। প্রচণ্ড যুদ্ধ হলো। কুরাইশ অশ্বারোহী বাহিনী দু-দুবার গিরিপথে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। এরপর কুরাইশরা রণে ভঙ্গে দিয়ে পালাতে লাগল। এ সময় মুসলিমরা গনিমত সংগ্রহে প্রবৃত্ত হলো। গিরিপথের পাহারায় নিয়োজিত তিরন্দাজদের ১২ জন ছাড়া বাকি ৩৮ জনও যুদ্ধ শেষ মনে করে গনিমত কুড়ানোতে লিপ্ত হলো। এই সুযোগে কুরাইশ বাহিনী গিরি অতিক্রম করে মুসলমানদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ করে ছত্রভঙ্গ করে দিল। অনাকাঙ্ক্ষিত এ পরিস্থিতিতে মুসলমানরা দিগ্‌বিদিক ছুটতে লাগল। মুসআব ইবনে উমায়ের ও নবীজির চাচা হামজা (রা.) শহীদ হলেন।
কুরাইশদের হামলায় হজরতের (সা.) জীবন বিপন্নপ্রায়। সাহাবায়ে কিরাম নিজেদের জীবন বাজি রেখে, নিজেদের বুককে ঢাল বানিয়ে নবীজিকে রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলেন। হামজা (রা.)-এর হত্যাকারী ইবনে কামিয়া নবীজিকে তরবারি দ্বারা তীব্র আঘাত করল। তালহা ইবনে উবায়দুল্লাহ (রা.) হাত দিয়ে ঠেকালে তাঁর আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে যায়, নবীজির শিরস্ত্রাণ বিদীর্ণ হয়ে দুটি লৌহ কড়া তাঁর কপালে বিঁধে গেলে তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। তখন কুরাইশরা ‘মুহাম্মদ নিহত!’ বলে উল্লাস করতে লাগল। শহীদ মুসআব (রা.)-এর চেহারা নবীজির সঙ্গে মিল থাকায় এ গুজব সহজে ডালপালা ছড়াল। এ যুদ্ধে ৭০ জন সাহাবি শাহাদতবরণ করেন। তাঁদের সমাধি ওহুদ প্রান্তরেই অবস্থিত। কুরাইশদের ৩৫০ জনেরও বেশি নিহত হয়।
সন্ধ্যার আগেই হজরত মুহাম্মদ (সা.) সবাইকে নিয়ে মদিনায় পৌঁছালেন। কুরাইশরা ‘আল আকিক’ উপত্যকায় পৌঁছানোর পর পুনরায় মদিনা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। এ সংবাদে নবীজি (সা.) রাতে বিশিষ্ট সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে পরদিন ১৬ শাওয়াল রোববার ফজরের পর ঘোষণা করলেন: ‘কুরাইশদের পুনরাক্রমণ প্রতিহত করতে শুধু ওহুদে অংশগ্রহণকারী সাহাবিরা প্রস্তুত হও।’ তাঁরা তখন নতুন অভিযানে চললেন। এদিকে কুরাইশরা ‘মাবাদ’ নামের এক মদিনাবাসী মারফত হজরতের পাল্টা অভিযাত্রার খবর জানতে পেরে পালিয়ে গেল। সাহাবাদের কাফেলা নিয়ে নবীজি (সা.) মদিনা থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে ‘হামরাউল আসাদ’ নামক স্থানে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে কয়েক দিন অবস্থান করে, শঙ্কামুক্ত হয়ে মদিনায় ফিরে এলেন। (বিশ্বনবী, গোলাম মুস্তফা, পৃষ্ঠা: ১৬৯-১৮৯; সিরাতে ইবনে হিসাব ও ইবনে ইসহাক; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম–এর সহকারী অধ্যাপক
[email protected]