জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সাফল্য স্বল্পমেয়াদি : এ এন এম মুনিরুজ্জামান

>হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছিল নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এ এন এম মুনিরুজ্জামানের। তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বর্তমান পরিস্থিতি, বিপদের আশঙ্কা এবং জঙ্গিবাদ মোকাবিলার দরকারি পথ ও কৌশল নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
এ এন এম মুনিরুজ্জামান
এ এন এম মুনিরুজ্জামান

প্রথম আলো: হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনার পর সরকার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। সরকারের এই ভূমিকা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

এম মুনিরুজ্জামান: সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা স্বল্প মেয়াদে কার্যকর। আমরা দেখেছি, হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর অনেক জঙ্গি ধরা পড়েছে। অনেকে গোলাগুলিতে মারা পড়েছে। গত দেড় বছরে বড় কোনো হামলার ঘটনা বা জঙ্গিবাদী তৎপরতা ঘটেনি। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এ ধরনের ট্যাকটিক্যাল অভিযানে যে ফল পাওয়া যায়, তা সাময়িক। আর এ ধরনের অভিযানের ক্ষেত্রে অনেক সময় আইনের শাসন মেনে চলা হয়নি। যেদিকে নজর থাকা উচিত।

প্রথম আলো: সরকারের জঙ্গিবিরোধী অভিযান ও এর ফলে জঙ্গিদের তৎপরতা কমে আসার বিষয়টিকে কি সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করছেন না?

এম মুনিরুজ্জামান: নিশ্চয়ই সাফল্য, তবে স্বল্পমেয়াদি। মনে রাখতে হবে যে জঙ্গিবাদের সমস্যা কোনো সাময়িক সমস্যা নয়। এটা একটা গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এটা মোকাবিলায় কৌশলগত উদ্যোগ দরকার। আমরা একে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি, সমাধানের পথ ধরছি না। এ জন্য জাতীয় কৌশল বা নীতি গ্রহণ ও সে অনুযায়ী উদ্যোগ প্রয়োজন।

প্রথম আলো: দেশে জঙ্গিবাদের বিপদ কিছু কমেছে কি?

এম মুনিরুজ্জামান: জঙ্গিদের বাহ্যিক বা অপারেশনাল কর্মকাণ্ড কমেছে, কিন্তু বীজ এখনো রয়ে গেছে। আমরা দেখছি, প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিদের আস্তানায় অভিযান হচ্ছে, গ্রেপ্তার ও অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হচ্ছে। বছরখানেক আগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের কাছে জঙ্গি হামলার একটি ঘটনা শেষ সময়ে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। অথচ সেখানে বিপুল আয়োজন ছিল। জঙ্গিরা সফল হলে বড় ক্ষয়ক্ষতি হতে পারত। ফলে বোঝা যায়, তাদের কর্মকাণ্ড থেমে যায়নি। পুলিশি অভিযানের মুখে তারা হয়তো এখন অপারেশন চালাতে পারছে না বা আমরা বাইরে থেকে তাদের কর্মকাণ্ড দেখতে পারছি না।

প্রথম আলো: জঙ্গি সংগঠনগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা মারা গেছে, সংগঠনগুলো কি দুর্বল হয়ে যায়নি?

এম মুনিরুজ্জামান: জঙ্গি সংগঠনগুলো সাংগঠনিকভাবে জীবিত রয়েছে। আমরা দেখলাম, জঙ্গি সংগঠন জেএমবি এখন শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও তাদের চ্যাপ্টার খুলেছে, জেএমআই। সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলে তারা এই কাজ পারত না। তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা রয়েছে, কিন্তু এখন হয়তো পুলিশের অভিযানের মুখে বা নিজেদের সিদ্ধান্তে তারা তাদের কর্মকাণ্ড স্থগিত রেখেছে। এ ধরনের শক্তি সাধারণত সব সময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। যখনই সুযোগ পাবে, তখনই কোনো ঘটনা ঘটাবে বা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জে একজন প্রকাশক খুন হয়েছেন।
একসময়ের ব্লগার ও মুক্তচিন্তার লোকদের হত্যার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, এই ঘটনাকে তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

প্রথম আলো: আইনগতভাবে জঙ্গিদের দমন করা কঠিন হচ্ছে কেন? আমরা দেখছি, হোলি আর্টিজানের ঘটনায় এখনো পুলিশ চার্জশিট দিতে পারেনি।

এম মুনিরুজ্জামান: এটা আসলে সক্ষমতা ও দক্ষতার সমস্যা। সে কারণে যেমন দীর্ঘসূত্রতা চলে, তেমনি জঙ্গিদের আইনিভাবে মোকাবিলা ও শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। তদন্তপ্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ায় দেখা যাচ্ছে, জঙ্গিরা আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে আসছে। এসব দুর্বলতা চিহ্নিত করতে বিচার–বিশ্লেষণ ও গবেষণা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

প্রথম আলো: যারা ইতিমধ্যে জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে; কিন্তু কেউ যাতে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ না হতে পারে, তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ সরকারের তরফে আছে কী?

এম মুনিরুজ্জামান: আগেই বলেছি, জঙ্গিবাদ একটি গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা। এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলায় জাতীয় নীতি–কৌশল থাকতে হয়। সমাজে উগ্রবাদী চিন্তার বিকাশ রোধ করতে নানা উদ্যোগ থাকতে হয়। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদের সমস্যা কিন্তু শুধু পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়। পরিবার, সমাজ, গণমাধ্যম, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ নানা কিছুর সম্পৃক্ততা রয়েছে এই সমস্যার সঙ্গে। সবদিক বিবেচনায় নিয়েই সমস্যা মোকাবিলার একটি জাতীয় কৌশল নেওয়া প্রয়োজন। পুলিশের পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। যারা জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে, তাদের সবাইকে তো মেরে ফেলা যাবে না। তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার কর্মসূচি থাকতে হবে। ডির‍্যাডিক্যালাইজেশনের নীতি ও কৌশল থাকতে হবে। উগ্রবাদীরা তাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে র‍্যাডিক্যাল ন্যারেটিভ প্রচার করে, তাকে মোকাবিলার জন্য আমাদের কাউন্টার ন্যারেটিভ থাকতে হবে। বুলেট দিয়ে আমরা সব মোকাবিলা করতে পারব না।

প্রথম আলো: পুলিশের অভিযানে অনেক জঙ্গি মারা পড়ে, অনেকে গ্রেপ্তার হয়। যারা গ্রেপ্তার হয়, তাদের জায়গা হয় কারাগারে। জোরালো অভিযোগ আছে যে সেখানে গিয়ে ছোটখাটো জঙ্গিরা বড় জঙ্গিতে পরিণত হয় এবং অন্য কয়েদিদের উদ্বুদ্ধ করে। কারাগারগুলো যেন অনেকটা জঙ্গিবাদ বিকাশের ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?

এম মুনিরুজ্জামান: আমাদের বর্তমানের জেল ব্যবস্থায় বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। কারাগারে জঙ্গিদের যেভাবে রাখা দরকার, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এর পেছনে আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের ব্যাপার যেমন রয়েছে, তেমনি জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জঙ্গিরা জেলখানায় যাচ্ছে, তারা অন্যদের জঙ্গি বানাচ্ছে। তারা সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। জেলখানায় গিয়ে একজন নিম্নপর্যায়ে জঙ্গি নেতৃত্বের পর্যায়ে চলে আসে। জেলখানায় নিজের অনুসারী সৃষ্টি করে। অথচ এই দিকগুলোতে আমাদের নজর নেই। আবার সাজা খেটে একজন জঙ্গি কারাগার থেকে বের হলে সমাজ ও পরিবার কেউই তাকে গ্রহণ করতে চায় না। কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হয়রানির শিকার হয়। ফলে কারাগারগুলো নিয়ে যেমন ভাবতে হবে, তেমনি জঙ্গিদের জন্য পুনর্বাসন কর্মসূচিও থাকতে হবে।

প্রথম আলো: জঙ্গিবাদী মতাদর্শ বিস্তারে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির ভূমিকা কতটুকু?

এম মুনিরুজ্জামান: আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। ফলে অনেকের মধ্যেই বঞ্চনার অনুভূতি রয়েছে। এই জনগোষ্ঠী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। অন্যদিকে রাজনৈতিকভাবে মত ও ভিন্নমত প্রকাশের পথ যত সংকুচিত হবে, এ ধরনের শক্তির বিকাশের বিপদ তত বাড়বে।

প্রথম আলো: সামনে নির্বাচন আসছে। এই পরিস্থিতিতে জঙ্গিদের সক্রিয় হয়ে ওঠার বিপদ কতটুকু?

এম মুনিরুজ্জামান: সাধারণত দেশে কোনো ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা বা অস্থিরতা থাকলে সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়। জঙ্গি বা উগ্রবাদীরা সব সময়ই এ ধরনের পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ফায়দা নিতে চায়। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি কোনো শূন্যতা থাকলে কেউ না কেউ সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে। জঙ্গিরা বা এ ধরনের শক্তি সব সময়ই তেমন সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।

প্রথম আলো: আপনি ও আপনার প্রতিষ্ঠান জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করে। আপনাদের পর্যবেক্ষণে দেশের জঙ্গি কার্যক্রমে নতুন কোনো প্রবণতা চোখে পড়ছে কী?

এম মুনিরুজ্জামান: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কয়েকটি প্রবণতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ধর্মীয় উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। বাংলাদেশে ইন্টারনেটের পেনিট্রেশন বেশ গভীর। এখানে কয়েক স্তরের ব্যবহারকারী রয়েছে। এখানে একটি স্মার্টফোনের তথ্য বা ছবি একাধিক ব্যবহারকারী বা যাদের স্মার্টফোন নেই, তারাও কাজে লাগায়। এটা শুধু শহরের সমস্যা নয়। দ্বিতীয়ত, নারীদের মধ্যে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটছে দ্রুতগতিতে। তৃতীয়ত, অনেক ক্ষেত্রে পরিবারগুলো একটি টেরর ইউনিট হিসেবে কাজ করছে। পিতা-মাতা, সন্তানসহ একটি পুরো পরিবার যখন একসঙ্গে কাজ করে, তখন সেখানে গোয়েন্দাদের প্রবেশ বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। চতুর্থত, প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ উগ্রবাদ বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। এটা একটা দ্বিমুখী পথ, বাংলাদেশ থেকেও যাচ্ছে, বাইরে থেকেও আসছে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

এম মুনিরুজ্জামান: ধন্যবাদ।