আশাহীনতার পোড়োজমিতে তরুণেরা কী চায়?

২০১৭ সালের মাঝামাঝি প্রথম আলো তারুণ্য জরিপের চিত্র
২০১৭ সালের মাঝামাঝি প্রথম আলো তারুণ্য জরিপের চিত্র

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২২ সালে টি এস এলিয়ট লিখলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতার বই ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’—‘পোড়োজমি’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাত্মক পরিণতি এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ রচনার তাড়না ছিল বলে বলা হয়। ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’-এর অন্তর্গত দৃশ্যগুলো বর্তমানের সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ। কবিতায় এক এলোমেলো হতাশাজনক পরিস্থিতির বিবরণ পাওয়া যায়। যেখানে মানুষ তার মৃত্যুর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলে বলে এলিয়ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেখানে মানুষের চেহারা খানিকটা ভূতের মতো হয়ে যায়।

বাংলাদেশে এখন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক ক্ষেত্রে চরম এক নৈরাজ্য পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভূতের চেহারা নিয়ে রাজনীতিবিদেরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর। তরুণ যে জনশক্তি, যাদের ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল, সেই তরুণেরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছে না। ফলে, সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা বাড়ছে। হতাশ যুবকেরা মিশে যাচ্ছে বিভিন্ন অসামাজিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অথবা মুষড়ে পড়ছে নিষ্ক্রিয়তায়।

প্রতিদিনই নতুন নতুন বেকার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, দেশে এখন সাড়ে চার কোটি মানুষ বেকার। এদের বড় অংশই শিক্ষিত তরুণ। রাষ্ট্র তরুণদের সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা কম, অন্যদিকে বেসরকারি খাতেও চাকরির সুযোগ কমেছে। সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে সুবিধা বৃদ্ধির কারণে তরুণদের মধ্যে সরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহও অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বেশি। কিন্তু বেসরকারি খাতে সেই অনুপাতে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না। এ কারণে চাকরির বাজারে একধরনের অসামঞ্জস্যতা আছে। স্বভাবতই কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে মরিয়া হয়ে নেমেছে। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নিপীড়কের ভূমিকায় উপস্থিত হয়েছে। অধিকারের কথা বলতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা দমন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর ভূমিকাও এখানে প্রশ্নবিদ্ধ। তরুণদের বড় অংশই সন্দিহান যে রাষ্ট্র তার ন্যূনতম মৌলিক অধিকার পূরণে সক্ষম কি না।

দার্শনিক ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব উইল ডুরান্ট তাঁর ‘সভ্যতার জন্ম’ বইয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে একটি রাষ্ট্র বা সভ্যতা এগিয়ে যায়। সুষম অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক উপাদানের সমন্বয়ে সভ্যতা বিকশিত হয়। এর কোনো একটির অভাব ঘটলেই রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়ে বা অকার্যকর হয়ে যায়। গাণিতিক ও তাত্ত্বিকভাবে দেখানো যাবে যে বাংলাদেশে গত কয়েক দশকের অর্থনীতি ঊর্ধ্বমুখী। বিভিন্ন সূচক আমলে নিয়ে উন্নয়নের চিত্রটি আরও স্পষ্ট হবে। প্রবৃদ্ধি বাড়লে স্বভাবতই এর সুফল সমাজের বিভিন্ন স্তরে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সম্পদ সমভাবে বণ্টিত হচ্ছে না। এ কারণে একদিকে যেমন ধনিক শ্রেণির উদ্ভব হচ্ছে, অন্যদিকে দারিদ্র্যও বাড়ছে। নগরকেন্দ্রিক অভিজাত এলাকার ঝাঁ-চকচকে অর্থনীতি দিয়ে সারা দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা সমীচীন না। অর্থনীতির অসাম্যের ধাক্কাটি প্রথমেই তরুণসমাজ বা সদ্য শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর গায়ে আছড়ে পড়ে। ব্যাংক খাতের হাজার হাজার কোটি টাকা হরিলুট, অন্যদিকে বেকারত্ব বৃদ্ধি। তরুণসমাজ এমনকি উদ্যোক্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারছে না—চাকরির বাজারে মঙ্গা। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যতটাই সহজ তরুদের জন্য ততটাই কঠিন।

অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য রাজনৈতিক দুর্বলতা দায়ী। বাংলাদেশে একটি কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর রাষ্ট্রকাঠামো জনবান্ধব না। অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। এখনো আমাদের ভোটের অধিকারের জন্য লড়তে হয়। জনগণের প্রতি রাষ্ট্র বা সরকারের দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক দলগুলো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করতে পারেনি। রাজনীতিকে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়াই মুখ্য কারণ। বাংলাদেশে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত রাজনৈতিক শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে। কার্যত, এদের কোনো পেশা নেই—রাজনীতিই তাদের পেশা। যদিও ইউরোপের রাজনৈতিক দলগুলোর মতো এরা নিয়োগপ্রাপ্ত নয়, বরং রাষ্ট্রের সম্পদ লুণ্ঠন করাই এদের মূল উদ্দেশ্য। একবার রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া গেলে রাতারাতিই তাদের অবস্থা বদলে যায়, তারা পরিণত হয় শানশওকতে জ্বলতে থাকা ভূতের মতো। এ জন্য মেধা বা দক্ষতার প্রয়োজন নেই।

বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণে মনস্তাত্ত্বিক দক্ষতা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ খুবই জরুরি। এই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের সংজ্ঞা ব্যাপক। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের একমাত্র উপাদান নয়। শিক্ষিত হয়ে মানুষ কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে, এটিই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মূল উপাদান না। বরং সমাজ-সভ্যতার সঙ্গে রাষ্ট্রের নাগরিক কীভাবে সম্পর্কিত হবে, সেই বোঝাপড়াই জ্ঞানভিত্তিক সমাজের ভিত্তি। জ্ঞান বিকাশের কেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন বন্ধ্যা ও আগ্রাসী রাজনীতির কেন্দ্র। জ্ঞানের জগতে আমাদের এমন কী অর্জন আছে, যা দেখে তারুণ্য অনুপ্রাণিত হবে? সমাজে জ্ঞানের চর্চা না থাকায় পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়ছেই। অথচ পশ্চিমা সমাজ এসব ঘৃণা-বিদ্বেষ থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছে। কারণ, অবারিত জ্ঞানচর্চা।

মোদ্দাকথা হচ্ছে, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মনস্তাত্ত্বিক জগতের মধ্যে সম্মিলন ঘটাতে না পারলে রাষ্ট্র-সমাজে হতাশা ও অস্থিরতা বাড়তেই থাকবে। বাংলাদেশেও ঠিক তা-ই হচ্ছে। এ কারণেই তরুণদের মধ্যে হতাশা দিন দিন বাড়ছেই। হতাশার কারণে তরুণদের মধ্যে ভিন্ন চিন্তা জায়গা করে নেয়। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের একটা অংশ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়। ধর্মকে আশ্রয় করে কেউ কেউ জঙ্গি সংগঠনে যোগ দেয়। বাস্তব জগতে যখন সমাধান আসছে না, তখনই অদৃষ্টবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের একটা অংশ। এসবের ধারাবাহিকতায় সমাজে অযৌক্তিক আচরণ বাড়তে থাকে। একধরনের সাংস্কৃতিক বন্ধ্যত্ব নেমে আসে। তবে এসবের কোনো কিছুই বর্তমান না; বরং অতীতের ধারাবাহিকতা।

বাস্তবতা হচ্ছে, যতই উন্নয়নের চিত্র নির্মাণ করা হোক না কেন জ্ঞানভিত্তিক সুস্থ সমাজ গড়ে না তুললে সমাজের পতন অনিবার্য। বাস্তবকে মোকাবিলার পথ বের করতে হবে। বাংলাদেশের সমাজ পতনের দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছে। তাই দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী রাজনীতিবিদদের পেছনে জনসাধারণের সমর্থন থাকে। গাড়ির চাকায় পিষে মারার অভিযোগে অভিযুক্ত সাংসদপুত্রের পক্ষে প্রকাশ্যে মিছিল হয়। শহীদ মিনারে কোটা সংস্কারপন্থী ছাত্রীকে ঘিরে ধরে যৌন হয়রানি করা হয় প্রকাশ্য দিবালোকে। কিছু লোক আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই যৌনহামলকারীদের পক্ষে প্রচারণা চালায়। এমন একটি সমাজে দাঁড়িয়ে তরুণেরা হতাশ, আশাহীন হবেই। এভাবে দেশ হয়ে যেতে পারে আশাহীনতার পোড়োজমি

জনসাধারণের অংশগ্রহণ ছাড়া যেকোনো রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু তা ভেঙে পড়ে সেই জনগণের ওপরই—রানা প্লাজার মতো।

ড. মারুফ মল্লিক: রিসার্চ ফেলো, সেন্টার ফর কনটেমপোরারি কনসার্নস, জার্মানি।