তোলো বন্ধু আমার কেহ নাই

সোমবার রাত থেকে বৃষ্টি পড়ছে চট্টগ্রাম নগরীতে। এতে নগরের নিচু সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পোর্ট কার্নেকটিং সড়কে খানাখন্দ থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীর। ছবি: জুয়েল শীল
সোমবার রাত থেকে বৃষ্টি পড়ছে চট্টগ্রাম নগরীতে। এতে নগরের নিচু সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পোর্ট কার্নেকটিং সড়কে খানাখন্দ থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীর। ছবি: জুয়েল শীল

ভারী বর্ষণে তো বটেই, কর্ণফুলীর জোয়ার-ভাটার কারণেও চট্টগ্রাম নগরের প্রায় অর্ধেক এলাকা ডুবে যাওয়া এখন স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আমরা শহরের রাজপথে নৌকা চলাচলের দৃশ্য যেমন দেখছি, তেমনি ডুবে যাওয়া আর ভেসে থাকা বাড়িঘর, হাসপাতাল, যানবাহন, শিক্ষা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ছবি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এ বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই তিন দফা ডুবেছে নগর। এতে আর্থিক ও মানসিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই।

বছরের পর বছর এই দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে নগরবাসী। কথা হচ্ছে সরকার কি জনদুর্ভোগের এই ভয়াবহতা নিয়ে উদাসীন বা নিষ্ক্রিয়? না, সরকারকে নিষ্ক্রিয়তা বা উদাসীনতার জন্য দায়ী করা যাবে না। কারণ, সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করেই জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ইতিমধ্যে ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার এবং ২ হাজার কোটি টাকার দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকার। বলে রাখা দরকার, সিটি করপোরেশনের পরিবর্তে এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ)। এ ছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডও প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে।

হাজার হাজার কোটি টাকার বরাদ্দের বিষয় নগরবাসীকে আশ্বস্ত করার কথা। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এ নগর জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে সেই আস্থা এখনো তৈরি হয়নি নগরবাসীর মনে।

খোদ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেই বলা হচ্ছে ‘এতগুলো টাকা প্রধানমন্ত্রী দিচ্ছেন চট্টগ্রামবাসীর উপকারের জন্য। সেই জায়গা থেকে প্রকল্পগুলোর কাজ তো টেকসই হতে হবে। সমন্বয় করে করা গেলে অবশ্যই টেকসই হবে, যদি তা নগর পরিকল্পনাবিদ বা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করেই বাস্তবায়ন করা হয়। যদি টেকসই না হয়, জনগণ তো ক্ষুব্ধ হবে।’

এই ‘যদি’র প্রসঙ্গটা কেন আসছে? আসছে উন্নয়নকাজের সমন্বয়হীনতার কারণে। সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন স্বীকার করেছেন, ‘নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে দেখা যায় সমন্বয়হীনতা এক নিষ্ঠুর বাস্তবতা।’

জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জারি করা পরিপত্রে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কিন্তু গত ২৪ জুন সিটি করপোরেশনের ডাকা সমন্বয় সভায় উপস্থিত ছিলেন না সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। ওই দিন তিনি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকা গিয়েছিলেন।

মন্ত্রণালয়ের বৈঠকটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কি না কিংবা সমন্বয় সভার দিনক্ষণ পরিবর্তন করা যেত কি না—এসব প্রশ্ন উত্থাপন না করেও আমরা দৃশ্যমান বাস্তবতার নিরিখে বলতে পারি, এ দুটি সংস্থার প্রধানের মধ্যে সমন্বয়ের তো বটেই, সুসম্পর্কেরও অভাব আছে। পরস্পরকে ‘ব্যর্থ’ প্রমাণ করার এই প্রবণতার ফল শেষ পর্যন্ত ভোগ করতে হবে নগরবাসীকেই। অথচ দুটি সংস্থার প্রধানই বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের লোক।

যত দূর মনে পড়ে, সিডিএ চেয়ারম্যান বছরখানেক আগে বলেছিলেন, জলাবদ্ধতার সমস্যাটি সমাধান করা কঠিন ব্যাপার নয়। আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম তাঁর এই আত্মবিশ্বাস দেখে। কিন্তু গত ২৮ এপ্রিল খাল খননকাজের উদ্বোধন করে তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে নগরবাসীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, এ বছরও জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হবে না।

তা-ও না হয় মানা গেল। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা এত দ্রুত সমাধান করা যে অসম্ভব, এ কথা মেনে নিতে কারও দ্বিধা নেই। কিন্তু সম্প্রতি নদী কমিশনের চেয়ারম্যান খাল খননকাজের পরিদর্শন করতে এসে খালের দুপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘বিসমিল্লায় গলদে’র প্রসঙ্গটি যে তুললেন তার কী ব্যাখ্যা দেবে সিডিএ?

আসলে গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা রোধে নানা রকম উদ্যোগ-আয়োজন দেখেছি আমরা। বর্ষা মৌসুম সামনে রেখে প্রতিবছরই চাক্তাই খালসহ বিভিন্ন খাল খননের তোড়জোড় শুরু হয়। কিন্তু মানুষের ভোগান্তি কিছুতেই কমে না।

চট্টগ্রামের তিনবারের নির্বাচিত মেয়র প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর ২০১০ সালের নির্বাচনে মোহাম্মদ মনজুর আলমের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে অনেকেই জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করেছিলেন। সেবার নির্বাচনের অব্যবহিত আগে দুদিন ধরে ভারী বর্ষণে জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল নগরের বড় একটি অংশ। মনজুর আলমও জলাবদ্ধতা নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মেয়াদকালেও জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হয়নি।

খাল খননের পাশাপাশি চাক্তাই খালে স্লুইসগেট বসানোর পরিকল্পনার কথা সম্প্রতি জানিয়েছেন সিডিএ চেয়ারম্যান। কিন্তু আমাদের দেশে স্লুইসগেট ব্যবস্থার অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। সাম্প্রতিক কালে চট্টগ্রামের মহেশখালের মুখে একটি অস্থায়ী বাঁধ স্থাপন করে দেড় বছরের মাথায় তা আবার অপসারণ করতে হয়েছে। এতে এর অসারতা প্রমাণিত হয়েছে।

মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে একবার চাক্তাই খালের তলদেশ ঢালাই করে দেওয়া হয়েছিল। এতে লাভ তো হয়ইনি, বরং এই উদ্ভট পরিকল্পনার জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন তিনি। সুতরাং এসব তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি বলে মনে করি আমরা।

সম্প্রতি সিডিএ পত্রপত্রিকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের নানা পদক্ষেপ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতেও জনমনে সংশয় দূর হয়নি। কারণ, কার্যত ‘ব্যর্থ’ একটি সমন্বয় সভা শেষে সিটি করপোরেশনের মেয়র সিডিএর উদ্যোগ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, ‘পত্রিকায় একেক সময় একেক রকম বক্তব্য আসছে। দলীয় মিটিংয়ে কথা হয়েছে সেখানে বক্তব্য আসছে আরেক ধরনের।’

জলাবদ্ধতা নিরসনে বাস্তবায়নাধীন ‘ওয়ার্ক শিডিউল’ জানতে চেয়ে সিডিএকে চিঠি দেবেন বলেও জানিয়েছেন মেয়র। করপোরেশনের সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সেবা সংস্থার ‘চিঠি চালাচালি’ আগেও হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি।

কথা হচ্ছে নগরবাসীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এই দুর্ভোগ নিরসনের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দও দিয়েছে সরকার। এখন সেবা সংস্থার প্রধানদের ‘ইগো’ সমস্যার কারণে এবং রশি টানাটানির কবলে পড়ে যদি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান না হয় তাহলে জনগণের ন্যূনতম আস্থাও হারাবেন তাঁরা। কোন সংস্থা কীভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে, সেটা সাধারণ মানুষের বিবেচ্য নয়—তাঁরা চান জলের অতল থেকে কেউ তাঁদের টেনে তুলুক।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক