প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে লোপেজকে

আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদর
আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদর

১ জুলাই মেক্সিকোর জনগণ তাঁদের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্দ্রেস ম্যানুয়েল লোপেজ ওব্রাদরকে নির্বাচিত করেছেন। নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর দেওয়া ঘোষণায় লোপেজ বলেছেন, ‘আমার একটি যুক্তিসংগত লক্ষ্য আছে। আমি মেক্সিকোর ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো প্রেসিডেন্ট হতে চাই।’

দেশের অভ্যন্তরে লোপেজ যা করবেন তা নিশ্চিতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ হবে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর আচরণ কেমন হবে, তার ওপরই তাঁর প্রশাসনকে সংজ্ঞায়িত করা যাবে। ২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ট্রাম্প বারবারই যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে একটি সীমানাপ্রাচীর নির্মাণের কথা বলেছেন, যার শতভাগ খরচ মেক্সিকোকেই দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প মেক্সিকোর অভিবাসীদের ধর্ষক ও অপরাধী বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং মেক্সিকো থেকে আমদানি করা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করেছেন।

ট্রাম্পের এসব বৈরী আচরণের পরও মেক্সিকোর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েতো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেন এবং ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘর্ষ যাতে না হয়, সেই চেষ্টা করেন। মেক্সিকানরা পেনা নিয়েতোর এই দাসভাবাপন্ন আচরণের তীব্র নিন্দা করে।

এদিকে লোপেজ জাতীয়তাবাদী টিকিটে নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনী প্রচারে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর পূর্বসূরির তুলনায় কম আপস করবেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় তিনি বারবার মেক্সিকোর সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানান। তিনি অভিবাসীদের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘ঘৃণা অভিযানের’ তীব্র সমালোচনা করেন এবং অভিবাসীদের কাছ থেকে তাঁদের শিশুদের বিচ্ছিন্ন করার নীতিকে উদ্ধত, বর্ণবাদী ও অমানবিক বলে আখ্যায়িত করেন।

তাঁর এসব অঙ্গীকার অনেক মেক্সিকান পছন্দ করে এবং তাঁকে এমন একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখে, যিনি কিনা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের মর্যাদা আবার ফিরিয়ে আনতে পারবেন। আগে মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক স্বাভাবিকই ছিল। ১৯৯০-এর দশকে মেক্সিকোর ব্যবসায়ী সম্প্রদায় উভয় দেশের বাণিজ্য আরও উন্মুক্ত করতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা শুরু করে। ব্যবসায়ীদের চাপে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোনাস সালিনাস ১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (নাফটা) চুক্তি করেন। এই চুক্তির ফলে মেক্সিকো বেশ লাভজনক অবস্থানে চলে যায়। পরবর্তী বছরগুলোয় নাফটা কেবল মেক্সিকোর অর্থনীতিকেই বদলে দেয়নি বরং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি বৈদেশিক নীতিতেও প্রভাব ফেলেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দেশটির আনুগত্যের মনোভাব গড়ে ওঠে। ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট পেনা নিয়েতো মেক্সিকোর ক্ষমতা গ্রহণ করার পর তিনিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের এই মনোভাব অব্যাহত রেখেছিলেন। তিনি মার্কিন প্রশাসনকে খুশি করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে যখন ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একজন প্রার্থী, তখন তিনি তাঁকে তাঁর প্রেসিডেনশিয়াল ভবনে আমন্ত্রণ জানান। মেক্সিকোর জনগণ তাঁর এই আচরণের ব্যাপক সমালোচনা করেন। তাঁদের মতে, যে প্রার্থী তাঁর নির্বাচনী প্রচারে মেক্সিকোবিরোধী প্রচারণা চালান, তাঁর প্রতি অপ্রয়োজনীয় এই শ্রদ্ধা প্রদর্শন ঠিক হয়নি।

ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করার পর তাঁর প্রশাসনকে সন্তুষ্ট করার জন্য মেক্সিকোর প্রচেষ্টা নজিরবিহীন মাত্রায় পৌঁছায়। পেনা নিয়েতো সরকার ওয়াশিংটনের নির্দেশে আরও আগ্রাসী অভিবাসন নীতি গ্রহণ করতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্র যখন মেক্সিকোকে তার সীমান্তে অভিবাসীদের আটক করা এবং বিতাড়িত করার জন্য বলেছিল, তখন পেনা নিয়েতো বিনা বাক্যব্যয়ে তা মেনে নেন। কিন্তু পেনা নিয়েতোর এসব কর্মকাণ্ড মেক্সিকানদের মধ্যে সমালোচিত হয় এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর ব্যর্থতা তাঁকে মেক্সিকোর ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্টে পরিণত করে। আসলে পেনা নিয়েতোর অজনপ্রিয় হয়ে ওঠা এবং মেক্সিকোর বর্তমান পরিস্থিতিই লোপেজকে প্রেসিডেন্ট হতে সাহায্য করেছে।

মেক্সিকোর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনবেন—এই আশাতেই ভোটাররা ম্যানুয়েল লোপেজকে ভোট দিয়েছেন। কাজেই এখন লোপেজকে তাঁর প্রতিশ্রুতি পূরণে সচেষ্ট হতে হবে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। আল-জাজিরা থেকে নেওয়া

মিগুয়েল গুয়েভারা হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির পাবলিক পলিসি প্রোগ্রামের স্নাতকোত্তর শ্রেণির গবেষক