গণতন্ত্রের স্বার্থেই প্রতিবাদ প্রয়োজন

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ কর্মসূচিতে বাধা দেয় পুলিশ

কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢালাও হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নিজেরাই হামলা-হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তাঁদের দুজন স্বল্প সময়ের জন্য পুলিশের দ্বারা আটকও হয়েছিলেন। কোনো সহিংস কাজ তাঁরা করেননি, আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন, এমন কথাও কেউ বলেনি। তারপরও পুলিশ তাঁদের সর্বসমক্ষে লাঞ্ছিত করে। অনুমান করি, এর লক্ষ্য একটাই, ভীতি সৃষ্টি করা। আন্দোলনকারীদের ভয় পাইয়ে নিষ্ক্রিয় করাই এসব জবরদস্তির উদ্দেশ্য।

অধ্যাপকদের মধ্যে যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, তাঁরা খুব নামজাদা কেউ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর বা বাইরে কেউকেটার অভাব নেই। আপাতত তাঁরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। বাবা, এখন মুখ না খোলাই ভালো। পিঠে হয় পুলিশের বাড়ি, নয়তো আমাদের সোনার ছেলেদের ধাওয়া খাওয়া-এই দুই থেকে বাঁচতে হলে চুপ থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ!

অবিচার-অনিয়মের বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কণ্ঠস্বর থেমে যায়, তখন গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। বাংলাদেশের ইতিহাস থেকেই আমরা জানি, গণতন্ত্র অর্জন করতে হলে বিস্তর খেসারত দিতে হয়। বঙ্গবন্ধুর কথাটা একবার ভাবুন, জীবনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তাঁকে কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। তাঁর সেই আত্মত্যাগের ফসল ছিল আমাদের স্বাধীনতা।

গণতন্ত্রের জন্য একদম সাধারণ মানুষও কম ত্যাগ স্বীকার করেনি। আমার ঘরে পাভেল রহমানের তোলা একটি ছবি রয়েছে নূর হোসেন নামের এক যুবকের। ঊর্ধ্ববাসবিহীন পেটানো শরীর, শক্ত দুই হাত মাথার পেছনে আলগোছে বাঁধা, তামাটে পিঠে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’। সামরিক সরকারের স্বৈরতন্ত্রের অবসান ঘটানোর আন্দোলনে অংশ নিয়ে সেই যুবক সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, সেদিন এই নূর হোসেন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তাঁর মতো আরও অনেকে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন, সে কারণেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছিল।

এই সহজ সত্যটি আমরা ভুলে গেছি। যে দেশের মানুষ গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ব্যক্তিগত ত্যাগে প্রস্তুত নয়, গণতন্ত্র তাদের ছেড়ে যাবে, এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, আমি আমেরিকার উদাহরণেও কথাটি বলছি। এই দুই দেশেই গণতন্ত্র পিছু হটছে, তবে তাদের মধ্যে একটা বড় ধরনের প্রভেদও রয়েছে। এক দেশে কার্যত কোনো প্রতিবাদ নেই, অন্য দেশটিতে প্রতিদিন প্রতিবাদের আওয়াজ তীব্রতর হচ্ছে।

গত আঠারো মাসে আমেরিকায় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে। নির্বাচনের আগেই ভাবা হয়েছিল, ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হলে এ দেশের গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হবে। সেই বিপদের চেহারাটি আমরা এখন প্রতিদিন টের পাচ্ছি। শুধু নিজের অতিরক্ষণশীল সমর্থকদের খুশি রাখতে ট্রাম্প একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যার ফলে আমেরিকার জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকার হুমকির মুখে। বর্ণভিত্তিক সমানাধিকার থেকে পরিবেশ সংরক্ষণ, নির্বাচনব্যবস্থার স্বচ্ছতা থেকে আর্থিক ব্যবস্থায় বিধিসম্মত নিয়ন্ত্রণ, এ সবই আজ বাতিল হতে চলেছে। কোনো কোনো আমেরিকান এই অবনমনে এতটা শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন যে নিজের দেশ নিয়ে তাঁরা গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বেদনার সঙ্গে বলেছেন, আমেরিকা এখন আর প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ নয়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নানা উপাত্ত ব্যবহার করে ঠিক একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন: না, আমেরিকা গণতান্ত্রিক দেশ নয়, এটি একটি গোষ্ঠীতন্ত্র (অলিগার্কি), যেখানে সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে অতি ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী।

বাংলাদেশেও যে ক্ষমতা একটি অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে, এ নিয়ে কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। ক্ষমতাসীন চক্র থেকে প্রতিবাদের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার নেই। কেউ সে অধিকার প্রয়োগ করতে চাইলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা সম্ভব এবং তা-ই করা হয়। ফলে তাঁদের কাছ থেকে কখনোই কোনো বিষয়ের সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ শুনি না। নাগরিক অধিকার আন্দোলন বা শ্রমিক আন্দোলন, সেসবও ক্ষমতার সঙ্গে এমনভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যে অধিকাংশের মুখেই রা নেই।

আমেরিকার অবস্থা কিছুটা ভিন্ন। এখানে ভিন্নমত প্রকাশের জন্য আইনসভার কোনো সদস্য বহিষ্কৃত হন না বটে, কিন্তু ট্রাম্প আমলে তাঁরা কেউ মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেন না। বস্তুত, দলের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ এখন এতটাই নিরঙ্কুশ যে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দলের অধিকাংশ সদস্যই ট্রাম্পের ছাতার নিচে আসতে একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। যে দু-চারজন মিনমিনে গলায় প্রতিবাদ করেন, তাঁদের প্রায় সবাই রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

আমেরিকা তার ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই এমন ঘন আঁধারে নিমজ্জিত হয়নি। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা এক জরিপের ভিত্তিতে বলেছে, নিজেদের দেশপ্রেমিক ভাবেন, এমন আমেরিকানের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছে। তাদের সম্মিলিত মনোভাবের প্রতিচ্ছবি মেলে ৪ জুলাই, আমেরিকার স্বাধীনতা দিবসে, নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সম্পাদকীয় বোর্ডের এক যৌথ মন্তব্যে। পত্রিকাটি লিখেছে, এই দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে, তাকে পুনর্জন্ম নিতে হবে। আর তা এখনো সম্ভব, অতীতে আমেরিকা নিজেকে বারবার পুনরাবিষ্কার করেছে।

এই পুনরাবিষ্কারের কেন্দ্রে রয়েছে আপসহীন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। শুধু আমেরিকা নয়, পৃথিবীর সর্বত্রই আমরা এই দৃশ্য দেখেছি। ক্ষমতাসীন মহল যত অন্ধের মতো ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করে, ক্ষমতাবলয়ের বাইরে তার বিরুদ্ধে তত উচ্চকণ্ঠ হয় প্রতিবাদ। নিউইয়র্ক টাইমস যে পুনর্জন্মের কথা বলে, তা কোনো বাগাড়ম্বর নয়। এই ট্রাম্প আমলেই আমরা দেখেছি, শুধু বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টি নয়, রিপাবলিকান চক্রের বাইরে আমেরিকার নাগরিক সমাজের এক ক্রমবর্ধমান অংশ ক্রমশ এই প্রতিবাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। নাগরিক সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত ও ক্ষমতাহীন অংশ-সংখ্যালঘু, নারী, অভিবাসী-তারাই এখন এই প্রতিবাদের সম্মুখসারিতে।

আশার কথা, রিপাবলিকান দলের ভেতরেও এখন শোনা যাচ্ছে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের উচ্চারণ। ঘোষণা দিয়ে দল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, এমন আমেরিকানের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। এ কথা ঠিক, যাঁরা বেরোচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই ক্ষমতার ভাগীদার নন। কিন্তু তাঁরা রাজনৈতিকভাবে একদম গুরুত্বহীনও নন। তাঁদের কেউ সাবেক কংগ্রেসম্যান, কেউ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা, কেউবা রাজনৈতিক রণকৌশলবিদ।

তাঁদেরই একজন স্টিভ স্মিথ, ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে জন ম্যাককেইনের প্রচারণা দলের তিনি ছিলেন প্রধান কর্মকর্তা। তিনি সম্প্রতি টুইটারে এক ঘোষণা দিয়ে রিপাবলিকান দল থেকে বেরিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ২৯ বছর ৯ মাস আগে আমি এই দলে যোগ দিয়েছিলাম। কারণ, এই দল মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। আজকের রিপাবলিকান পার্টি সম্বন্ধে সে কথা বলা যাবে না। এটি এখন পুরোপুরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি দল।

এবার প্রতিতুলনার জন্য বাংলাদেশের দিকে তাকানো যাক। ক্ষমতার ভাগীদার বা সাংসদ, এমন কারও কথা আমি ভাবছি না। নিজেদের নরম গদিখানা ফসকে যায়, এমন কোনো কাজ তাঁরা কখনোই করবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী, তাঁরা তো চিরকাল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শিরোভাগে থেকেছেন। এখন তাঁরা কোথায়? সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পেয়েছেন, এমন মানুষ-তাঁদের মধ্যে লেখক, সাংবাদিক ও বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবী রয়েছেন-তাঁদের কেউ কি মনের মধ্যে কখনো এমন ভাবনার আশ্রয় দিয়েছেন যে নরম গদির চেয়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানবিক মর্যাদা ও আইনের শাসনের পক্ষে দাঁড়ানো অনেক সম্মানজনক? নৈতিক কারণে লাভ-ক্ষতির অঙ্কের বাইরে গিয়ে নিজের গলাটি উঁচু করাটা অনেক জরুরি?

এই প্রশ্নের উত্তরে ঢালাওভাবে আমি ‘না’ বলব না। বিপদ হতে পারে, এ কথা জেনেই তো রাস্তায় নেমেছিলেন অধ্যাপক রেহনুমা আহমদ, ফাহমিদুল হক ও অন্যরা। প্রতিবাদের নিবু নিবু সলতেটি তাঁরা যে এখনো টিকিয়ে রেখেছেন, আমাদের পিছু হটা গণতন্ত্রের জন্য সেটা একধরনের আশার কথা বৈকি।

হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি