বরিশালে আশার চেয়ে শঙ্কা বেশি

‘বাংলার ভেনিস’ বরিশাল বর্ষার মৌসুমে আরও স্নিগ্ধ ও সবুজ হয়ে ওঠে। কীর্তনখোলার দুই তীরের নিবিড় বনরাজি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলার কথাই মনে করিয়ে দেয়। ঢাকার সদরঘাট থেকে ভোর সাড়ে পাঁচটায়ও মানুষ লঞ্চ থেকে নেমে শহরে যেতে ভয় পান। কিন্তু মঙ্গলবার রাত চারটায় দেখলাম, সুন্দরবন-১১ বরিশাল সদরঘাটে থামতেই কাছের যাত্রীরা রিকশা ও ইজিবাইকে এবং দূরের যাত্রীরা মাইক্রোতে উঠে বসলেন। ছিনতাই-ডাকাতির ভয় নেই। দূরের যাত্রীদের কেউ কেউ যাবেন কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে; বরিশাল থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। লেবুখালীতে সেতু হলে লাগবে দুই ঘণ্টা।
৩০ জুলাই বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন, কিন্তু শহরে ভোটের উত্তাপ নেই। আছে বিশ্বকাপের হুল্লোড়। আমরা কাঠপট্টি সড়কে ‘এথেনা’ নামে যে আবাসিক হোটেলে ছিলাম, তার পাশেই ব্রাজিল দলের মনোগ্রামসংবলিত একটি বিশাল ব্যানার টাঙানো ছিল। শুনেছি আর্জেন্টিনার ব্যানারও ছিল, দলটি হেরে যাওয়ার পর সমর্থকেরা নামিয়ে ফেলেছেন। বিশ্বকাপ কিংবা নির্বাচন—কোনোটিতেই পরাজিতের খোঁজ কেউ রাখেন না। দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য হলো একবার বিশ্বকাপে যারা জয়ী হয়, তারা পরেরবার ছিটকে পড়ার বাস্তবতা সহজে মেনে নেয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকেরা মানতে চান না। ভালো না খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে চান।
বুধবার সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে দেখি একটি চায়ের দোকানে কয়েকজন বসে আছেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে যোগ দিই। একথা-সেকথার পর জিজ্ঞেস করি, ‘ভোট তো আইছে, কী ভাবছেন।’ গেঞ্জি পরা মধ্যবয়সী একজন বললেন, ভোট হয় দুই রকম। এক ভোট হয় সত্যিকার ভোট। আরেক ভোট হয় ‘মেকানিজনম’। তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করি, এবার বরিশালে কোনটা হবে? তিনি বললেন, ‘হেইডা অহনই কওন যাইব না। ভোট দিতে যামু। পারলে দিমু, না পারলে বুঝুম মেকানিজম হইছে।’ পরে তাঁর পরিচয় পেলাম, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন। তাঁর কথায় আশার চেয়ে হতাশাই বেশি।
গত দুই দিনে বরিশালের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে ভোট নিয়ে কথা বলেছি। রিকশাচালক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, খুদে দোকানদার থেকে আইনজীবী, যাঁদেরই জিজ্ঞেস করেছি, দলান্ধ ছাড়া প্রায় সবাই ভোট নিয়ে তাঁদের শঙ্কা ও ভয়ের কথা শুনিয়েছেন। আবার অনেকে ভোট নিয়ে কথা বলতেই রাজি নন। বলেছেন, ‘ভোট দিয়ে কী হইব। আমাদের কাম কইরাই খাইতে হইব।’
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী সাতজন। রিটার্নিং কর্মকর্তা দুই প্রার্থীর মনোনয়ন বাদ দিলে তাঁরা আদালতে মামলা করে প্রার্থিতা ফেরত পান। এর মধ্যে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও আছেন। তিনি প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করলে আওয়ামী লীগকে ‘মিত্রের’ বিড়ম্বনা সইতে হবে, যেমন সিলেটে বিএনপিকে পোহাতে হতে পারে জামায়াতের ‘যন্ত্রণা’। বরিশালে মেয়র পদে প্রার্থী পাঁচ বা সাত যা-ই হোক না কেন, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে আওয়ামী লীগের সাদিক আবদুল্লাহ ও বিএনপির মজিবর রহমান সরোয়ারের মধ্যে। এর মধ্যে সাদিক বয়সে নবীন, তাঁর জীবনের প্রথম নির্বাচন। আর মজিবর রহমান সরোয়ার অভিজ্ঞ প্রার্থী, এর আগে তিনি তিনবার সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়রও ছিলেন তিনি।
যেকোনো নির্বাচনে প্রার্থী ও দলের গুণাগুণ বেশি আলোচিত হয়। দলগুলো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরে। প্রতিপক্ষের সমালোচনার জবাব দেয়। কিন্তু এবারের সিটি নির্বাচনে প্রার্থী বা দলের গুণাগুণ, এমনকি বরিশালের উন্নয়নে কে কী করবেন, সেসব নিয়েও কাউকে খুব বেশি আলোচনা করতে দেখলাম না। সবার প্রশ্ন, ‘ভোটটি কেমন হবে?’। ভোটাররা কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন কি না? তবে বিএনপির সমর্থকেরা মনে করেন, গাজীপুর আর বরিশালের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে তাঁদের প্রার্থীকে ধমক দিয়ে মাঠছাড়া করা যাবে না।
যিনিই জিতুন, বরিশালবাসীও চান লড়াইটা সমানে সমান হোক। নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি বললেন, ২০০৮ সালের আওয়ামী লীগের প্রার্থী কিন্তু ভোটকেন্দ্র পাহারা দিয়ে নির্বাচনের জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এবারও শুরু থেকে ভোটকেন্দ্র পাহারা দিতে হবে।
স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলি। উভয় দলই জয়ের বিষয়ে ‘শতভাগ’ আশাবাদী। বিএনপি নেতাদের যুক্তি হলো বরিশাল বরাবর তাঁদের শক্ত ঘাঁটি। ১৯৭৩-এর পর ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোনো সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের ভরাডুবি হলেও বিএনপি প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার জয়ী হন। এর আগে সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে তিনি রাস্তাঘাট প্রশস্ত করেছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাঁর সময়েই বরিশাল বাইপাস হয়েছে। বিএনপি সরকার বরিশাল বিভাগ করেছে, বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে খালেদা জিয়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেছিলেন (যদিও তখন এর নামকরণ করা হয়েছিল জিয়াউর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়)। তাই এ কথা বলার সুযোগ নেই যে বিএনপির আমলে উন্নয়ন হয়নি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের পাল্টা যুক্তি হলো বিএনপির মেয়র আহসান হাবিব গত পাঁচ বছরে কোনো কাজ করেননি। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেহাল। শহরে জলাবদ্ধতা বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকায় কোনো কাজই হয়নি। শহরের যা কিছু উন্নয়ন, তা করেছেন সাবেক মেয়র শওকত হোসেন। ভোটাররা বুঝে গেছেন, সরকারি দলের প্রার্থীকে ভোট দিলেই বরিশালের উন্নতি হবে, নাগরিক সমস্যা দূর হবে। তাঁদের দাবি, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য হওয়ায় সরকারের কাছ থেকে বেশি বরাদ্দ আনতে পারবেন।
বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বড় নালিশ ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে ধ্বংস ও নৈরাজ্য চালিয়েছে তারা। জনগণ নৈরাজ্য প্রত্যাখ্যান করবে এবং উন্নয়নের পক্ষে রায় দেবে। এর জবাবে বিএনপি বলছে, আওয়ামী লীগ তো ভোটব্যবস্থাটাই ধ্বংস করছে। তাই গণতন্ত্র উদ্ধার করতে হলে ধানের শীষেই ভোট দিতে হবে।
দুই দলের এসব যুক্তি-পাল্টাযুক্তি ভোটারদের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে এবং ভোটাররা কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানান, তার ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনটি কেমন হবে। আলাপ প্রসঙ্গে বরিশালের এক আওয়ামী লীগ নেতা বললেন, গাজীপুরে ও খুলনায় সুষ্ঠু ভোট হয়েছে এবং তাঁদের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এখানেও আওয়ামী লীগ জয়ী হবে। এ সম্পর্কে বিএনপি নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, গাজীপুর ও খুলনায় যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়ে থাকে, তাহলে তো সুষ্ঠু নির্বাচনের সংজ্ঞাই পাল্টে দিতে হয়। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচনে কখনো জয়ী হতে পারবে না বলেই গাজীপুর-মার্কা নির্বাচন করতে চায়।
অভিযোগের সুরে তাঁকে বলি, আপনারাও মাগুরা-মার্কা নির্বাচন করেছেন। বিএনপি নেতার জবাব, ‘আমরা একটি মাগুরা-মার্কা নির্বাচন করেছি ঠিক। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো ঘরে ঘরে মাগুরা তৈরি করেছে। ইউনিয়ন পরিষদ বলুন আর উপজেলা, সিটি করপোরেশন নির্বাচন বলুন, সবখানেই জবরদস্তি চালাচ্ছে তারা।’
কিন্তু বরিশালের ভোটাররা, বিশেষ করে যাঁরা এই রাজনৈতিক বাহাসে যোগ দিতে চান না, তাঁরা চান যিনিই জিতুন, নির্বাচনটি সুষ্ঠু হোক। মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারুক। কীভাবে সেটি সম্ভব? নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, ভোটের পরিবেশটি সুন্দর থাকতে হবে। সব দলকে নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। বিরোধী দল এখন আর সমান সুযোগ আশা করে না, তারা চায় অন্তত মাঠে টিকে থাকার পরিবেশ বজায় থাকুক।
সেটি নিশ্চিত করার উপায় কী। বরিশালের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বললেন, উপায় হলো আইন নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, সেটি পুরোপুরি প্রয়োগ করা। সিইসি কে এম নুরুল হুদা টিএন সেশন (ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) না হতে পারেন, এ টি এম শামসুল হুদার ভূমিকা তো নিতে পারেন। কমিশনের কথা, কাজ ও আচরণে জনগণের মধ্যে এই প্রতীতি জন্মাতে হবে যে তারা কারও হুকুমে চলে না। বরং নির্বাচনের বিষয়ে রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের হুকুমে চলে।
খুলনা ও গাজীপুরে কমিশন শক্ত ভূমিকা নিতে পারেনি। বরিশালে পারবে কি না, সেটি দেখার জন্য আমাদের ৩০ জুলাই তক অপেক্ষা করতে হবে।

আগামীকাল: কোন্দল–বিরোধ আছে দুই দলেই

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]