যুক্তিনির্ভর জাতি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন

দাবা একসময় রাজরাজড়ারা খেলতেন। ভারতেই ‘চতুরঙ্গ’ নাম দিয়ে খেলাটির সূচনা। সেই খেলায় বাংলাদেশের ছেলে নিয়াজ মোরশেদ সুযোগ-সুবিধা বিরহিত হয়েই পুরোদস্তুর গ্র্যান্ডমাস্টার হয়েছিলেন। তিনি আরেকবার প্রমাণ
করেছিলেন বাঙালি কৃশকায় হতে পারে, সমতল ভূমির
মানুষ বলে তার গায়ে জোরও কম থাকতে পারে, কিন্তু বুদ্ধিতে তার শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে।
আমার ছোটবেলার পড়ালেখা হয়েছে রাশিয়ায়, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নে। দীর্ঘদিন ধরে দাবার রাজ্যে রাশিয়ানরা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে এসেছে। তাদের আধিপত্য এমন মাত্রারই ছিল যে রাশিয়া এবং বাকি পৃথিবীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। ১৯৭০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর বাকি পৃথিবীর মধ্যে বেলগ্রেড শহরে প্রতিযোগিতা হয়, যাতে সোভিয়েতরা বিজয়ী হয়। এরপর ১৯৮৪ সালে লন্ডনে এ রকম প্রতিযোগিতা হয়, যাতে আবার সোভিয়েতরা বিজয়ী হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল। এবার ২০০২ সালে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে এ রকম প্রতিযোগিতা হয়। সেখানেও আবার রাশিয়ানরা একাই গোটা বিশ্বকে হারিয়ে দিল।
মনে রাখতে হবে, এই প্রতিযোগিতা যখন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন ববি ফিশারের ফর্ম ছিল তুঙ্গে এবং বেশ কয়েকজন শক্তিশালী দাবাড়ু সোভিয়েত ইউনিয়ন ত্যাগ করে পশ্চিমা বিশ্বের হয়ে অংশগ্রহণ করেছেন।
রাশিয়ায় তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চাদের দেখেছি স্কুলে (লেনিনের বাগান) যাওয়ার আগে দাবার স্কুলে যেত। সেখানে চেয়ারে না বসে দাঁড়িয়ে খেলত। সামনে ৩২টি ঘুঁটি নিয়ে চঞ্চল হাতগুলো গুটিয়ে গভীরভাবে চিন্তামগ্ন হতো। এ এক অসাধারণ দৃশ্য! এই ছোট মানুষগুলো জানে দাবার বোর্ড সামনে নিয়ে চাল দিতে হয় না, চিন্তা করতে হয়। আমরা আমাদের দেশে প্রবীণেরাও হয়তো চিন্তা না করলেও চাল দিই। আমরা প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দেখি রাশিয়ান ছেলেমেয়েদের ভাষাজ্ঞানে দুর্বলতা থাকতে পারে, তারপরও প্রতিটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব নিরঙ্কুশ। গত সাত বছর রাশিয়ানরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আমার মনে হয় রাশিয়ানদের বিশ্লেষণী ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বে দাবা খেলার একটা অবদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লে ম্যাথমেটিকস ইনস্টিটিউট সাতটি সেরা সমস্যার প্রতিটির জন্য এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল, তার মাত্র একটি সমাধান করা হয়েছে এবং তা করেছেন একজন রাশিয়ান—গ্রেগরি পেরেলম্যান, যদিও তিনি পুরস্কার নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডে একসময় উপমহাদেশে বাংলাদেশের মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল। আমাদের জগদীশ বসু, সত্যেন বোস আর মেঘনাদ সাহা বিজ্ঞানে কালজয়ী আবিষ্কার করেছিলেন যথেষ্ট প্রতিকূল ঔপনিবেশিক পরিবেশে। স্বাধীন দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে আমাদের শ্রেষ্ঠত্বের বিকাশ হওয়া উচিত ছিল। দেশে মনে হচ্ছে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের কদর কমেছে। বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আমাদের জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি—প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ১২০ জন। মাথাপিছু প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের নিদারুণ কম। যা আছে তাতে প্রাযুক্তিক দক্ষতা দিয়ে মূল্য সংযোজন করতে হবে, যা জাপানি আর কোরিয়ানরা করছে। সুতরাং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য জ্ঞান–বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দক্ষতায় আমাদের বিশ্বমানের হতে হবে।
মালয়েশিয়া আর কোরিয়া শিক্ষায় বিনিয়োগ করে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। যদিও ৫০ বছর আগে উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমরা এক কাতারেই ছিলাম। শিক্ষায় এখনো পর্যাপ্ত বিনিয়োগ দেখছি না। নানা রকম গেজেটে আর দৃষ্টি আকর্ষণের ঘটনায় আমাদের ছেলেমেয়েরা কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারছে না। অথচ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির গবেষণায় গভীর মনোনিবেশের বিকল্প নেই। তাই আমার মনে হয় আমাদের দেশে দাবা খেলাটাকে উৎসাহিত করা উচিত।
যোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলেও অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হলো দাবায় আমাদের দেশের তরুণ দাবাড়ুরা তাদের শ্রেয়তর দক্ষতা প্রমাণ করেছে। সারা দক্ষিণ এশিয়ায় যখন দাবার সর্বোচ্চ উপাধিধারী গ্র্যান্ডমাস্টার ছিল না, তখন নিয়াজ মোরশেদ প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার! আমরা কি এই অর্জন কখনো যোগ্যভাবে উদ্‌যাপন করেছিলাম? পৃথিবীতে ২০০ জনের মতো গ্র্যান্ডমাস্টার ছিলেন, তার একজন আমাদের দেশের!! এরপর জিয়াউর রহমান (২০০২), রিফাত বিন সাত্তার (২০০৬), আবদুল্লাহ আল রাকীব (২০০৭), এনামুল হোসেন রাজীব (২০০৮)। এ ছাড়া ৩ জন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার,
১২ জন ফিদে মাস্টার এবং ২ জন মহিলা ইন্টারন্যাশনাল মাস্টারও রয়েছে।
বিশ্বনাথন আনন্দ নিয়াজের দুই বছর পরে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে আবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়নও হয়েছে। এতে ভারতের আত্মবিশ্বাস যে কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানেও কিন্তু তারা একইভাবে এগোচ্ছে। ভারতের রকেট চাঁদে যায়, মঙ্গল গ্রহে যায়, আরও কত জায়গায় যাবে। দাবা খেলায়ও এগোচ্ছে। ভারতে এখন ৪৮ জন গ্র্যান্ডমাস্টার। একসময় আমাদের ছিল একজন আর ভারতের ছিল শূন্য জন!
২০০০ সালের পর থেকে প্রতিবছরই ভারত থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার হচ্ছে, ২০১৭ সালে হয়েছে ৪ জন। মহিলাদের মধ্যেও রয়েছে ১১ জন গ্র্যান্ডমাস্টার। ভারত এখন দাবার জগতে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। অতি সম্প্রতি রাশিয়ার সোচি শহরে ৭৯টি রাশিয়ান এবং ২১টি বিদেশি দলের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারতীয় খুদে দাবাড়ুরা! এখনো ফিদে রেটিংয়ে প্রথম ৩২ জনের মধ্যে ৩ জন ভারতের। এ অবস্থানটি আমাদেরও হতে পারত, যদি আমরা এই খেলাকে অগ্রাধিকার দিতাম, বুদ্ধির চর্চায় এ খেলাটির গুরুত্ব যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারতাম!
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে সাদা-কালো ৬৪ নামের দাবা প্রকাশনা থেকে একটি নিমন্ত্রণ পেলাম ৩১ মার্চ অনুষ্ঠানে। দাবা ফেডারেশনের চাকচিক্যহীন পরিবেশ দেখে কিছুটা মর্মাহত হলাম। যে দেশে যার কদর! দামি দামি দাবাড়ুদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের বিনয়ে, তাদের দেশপ্রেমে অভিভূত হলাম। দেশের তরুণ প্রজন্মের মেধা বিকাশের জন্য দাবা যে কত জরুরি তা বোঝানোর চেষ্টা করল। নিজেরা উদ্যোগী হয়ে, বিশেষ করে অগ্রসর স্কুলগুলোয় তারা নানা কাজে সম্পৃক্ত হয়। কারণ, তারা দাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সবই এখন চলছে তাদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এই ব্যক্তি উদ্যোগে তো দেশে এমন পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।
দাবা মানুষকে যুক্তিনির্ভর করে ও একনিষ্ঠ করে, গভীর চিন্তায় উৎসাহিত করে, বিশ্লেষণী ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। সুখের বিষয়, প্রথম আলো পত্রিকার বিজ্ঞানচিন্তা ম্যাগাজিনে দাবাকে উৎসাহিত করার জন্য সমস্যা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের একমাত্র উদ্বৃত্ত মানবসম্পদ যার উন্নয়নের মাঝে নিহিত আমাদের জাতীয় সাফল্য। এ কাজটি করার জন্য আমার মনে হয় স্কুলের ক্রীড়া উৎসবের সঙ্গে দাবাকে সংযুক্ত করে দেওয়া উচিত।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস