বর্ষা শুরু, ঢাকা কতটা প্রস্তুত?

ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথম আলো ফাইল ছবি
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথম আলো ফাইল ছবি

এবার বর্ষা ঋতু শুরুর বেশ আগে থেকেই বর্ষণ শুরু হয়েছে। বছর কয়েক আগেও ঘণ্টাখানেকের প্রবল বর্ষণে ঢাকা মহানগরী এত বেশি জলমগ্ন হতো না, কিন্তু এখন এক-দুই ঘণ্টার ভারী বর্ষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হাঁটু থেকে কোমরপানিতে তলিয়ে যায়। ফলে মানুষকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

এই নগরে বৃষ্টি ছাড়াই মানুষের অনেক মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে যানজটের কারণে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘নগর পরিস্থিতি’ শীর্ষক ২০১৫-এর বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যস্ত সময়ে ঢাকা নগরীতে গাড়ির গড় গতিবেগ ২০০৪ সালের ঘণ্টাপ্রতি ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার থেকে নেমে ২০১৫ সালে ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে পৌঁছেছে, যা হাঁটার গতির থেকে একটু বেশি। সম্প্রতি বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা যায়, যানজটের কারণে ব্যস্ত সময়ে রাজধানীতে গণপরিবহনের গতি এখন ঘণ্টায় গড়ে ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এটা হাঁটার গতির সমান। আর বৃষ্টিতে জলমগ্ন হলে প্রকট যানজটে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে।

জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ: নগরীর মাটির ৮০-৯০ ভাগ কংক্রিটে ঢাকা পড়েছে, তাই মাটির পানি শুষে নেওয়ার পথ বন্ধ। পানি সরে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অর্থাৎ নর্দমা ও খাল বেদখল হয়ে গেছে। খালগুলো হয় ভরাট হয়েছে, নয় আবর্জনা-পলিথিনের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা ধ্বংসের পাশাপাশি অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বিভিন্ন সংস্থার সংস্কারকাজের কারণে ম্যানহোলের ঢাকনা নষ্ট হয়ে যাওয়া, বৃষ্টির সময় ঢাকনা না খোলা, অপরিকল্পিতভাবে বক্স কালভার্ট নির্মাণ ইত্যাদি কারণে ঢাকায় বৃষ্টি হলেই মানুষ জলাবদ্ধতা ও তীব্র যানজটের শিকার হচ্ছে।

প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য মোট ভূমির ১২ শতাংশ জলাধার প্রয়োজন, কিন্তু ঢাকায় টিকে আছে মাত্র ২ শতাংশ। নগরীর ৫৮টি খালের মধ্যে ৩৭টির অংশবিশেষ রাজউকসহ তিনটি সরকারি ও সাতটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল এবং ২৪৮ জন ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। (প্রথম আলো, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫)। ঢাকা ওয়াসার আওতায় ২৬টি খালের মধ্যে যে কয়টার এখনো নিশানা আছে, সেগুলোও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পলিথিন আর ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা এবং দুই সিটি করপোরেশনের। এ ক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি, এমন নয়। কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান ঘটেনি। এ জন্য অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে অবিলম্বে সব খাল উদ্ধার করতে হবে। অবৈধ দখলদারেরা প্রভাবশালী হওয়ায় ওয়াসা কিংবা সিটির পক্ষে খাল উদ্ধার-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর আগে বহুবার জেলা প্রশাসন, ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ খালের দেখভালের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য সংস্থা সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা ও কর্মসূচির মাধ্যমে খাল উদ্ধার করার কথা বলা হয়েছে এবং কিছু চেষ্টাও হয়েছে। কিন্তু তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি।

আইন অনুযায়ী সব খালের মালিক জেলা প্রশাসন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। ওয়াসা বলছে, তারা ২৬টা খাল জেলা প্রশাসন থেকে বুঝে নিয়েছে এবং শুধু সেগুলোরই সংস্কার করছে, বাকিগুলোর ব্যাপারে তারা জানে না। খালের মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দিলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। ধারাবাহিক সমন্বিত প্রচেষ্টার অভাবে জনগণের বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও নগরীর জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বরাদ্দের জটিলতার কারণে বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সময়মতো শুরু ও শেষ না হওয়ায় জনগণের অর্থ জলে যাচ্ছে।

ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে সরকারকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমত দরকার জনগণের এবং দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পানিতে ডুবে যাওয়ার পথ তো আমরাই তৈরি করছি। আমাদেরই নিত্যব্যবহৃত পলিথিনে খাল-নর্দমা ভরে গেছে। পলিথিন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এ জন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।

ঢাকার রাস্তায় বৃষ্টির সময় ড্রেন এবং ম্যানহোলের ঢাকনাগুলো সহজে খোলার ব্যবস্থা করতে হবে; বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা, ফুটপাত ইত্যাদি সংস্কারের পর পানিনিষ্কাশনের ঢাকনাগুলো যাতে সংস্কার হয়, তা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র বক্স কালভার্ট নির্মাণ, পাম্প দিয়ে পানি সেচে ফেলার চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। খাল উদ্ধার ও সংস্কারের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে বর্ষার আগেই খাল ও নর্দমা সংস্কারের কাজ শেষ করতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে সময়মতো অর্থ ছাড় করতে হবে। তা না হলে আমরা সামান্য বৃষ্টিতেও ঢাকার রাস্তায় পানিতে ডুবে থাকব।

মো. মাহান উল হক ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত গবেষক