পেটালেন কেন? দায় কার?

হাতুড়ি দিয়ে নির্বিচারে পেটানো হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র তরিকুলকে। তরিকুলের অপরাধ, তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ এই প্রতিবাদ সমাবেশকে দাঁড়াতেই দেয়নি ছাত্রলীগ। এঁদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা রামদা, হাতুড়ি ও লাঠিসোঁটা নিয়ে চড়াও হন। নির্বিচার মারধরের একপর্যায়ে তরিকুলের পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া হয়।

হাতুড়িওয়ালা আবদুল্লাহ আল মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা। হাতুড়ি হাতে তাঁর ছবি, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলকে আঘাত করার ছবি এবং তরিকুলের ভাঙা হাড়ের এক্স-রের ছবিতে এখন সামাজিক গণমাধ্যম সয়লাব হয়ে গেছে। মামুনের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছেন অনেকে। কিন্তু দোষটা কি আসলে শুধু হাতুড়িওয়ালা মামুন ও তাঁর মতো আক্রমণকারীদের?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতারা অস্বীকারও করেননি যে তাঁরা পিটিয়েছেন তরিকুলকে। তাঁরা নাকি ধারণা করেছিলেন যে তরিকুলদের সমাবেশে জামায়াত-শিবিরের লোক থাকতে পারে, এবং এই সমাবেশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণকারী কিছু ছাত্রলীগ নেতাও এমন বক্তব্য দিয়েছেন। এর সোজাসাপ্টা মানে হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন কেউ অস্থিতিশীলতা বা নাশকতার চেষ্টা করছে, শুধু এমন ধারণা হলেই তাঁরা তাকে হাতুড়ি, রামদা, লাঠি দিয়ে পেটাতে পারেন।

প্রশ্ন হচ্ছে এটা দেশের কোন আইনে লেখা আছে? বাংলাদেশে কোনো আইন বা সংবিধানে কি লেখা আছে যে কোনো সমাবেশে গোলযোগ সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে সেখানে নির্বিচার হামলা করে কারও হাড়গোড় ভেঙে দেওয়ার অধিকার সরকারি ছাত্রসংগঠনের রয়েছে? নেই। এ ধরনের আশঙ্কা সত্যি থাকলে কেবল পুলিশ ব্যবস্থা নেবে, উপযুক্ত প্রমাণ থাকলে কাউকে গ্রেপ্তার করবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে এমন কোনো আশঙ্কাও ছিল না। এই আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন প্রথম হামলা চালিয়ে আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হককে গুরুতরভাবে আহত করা হয়, সেদিন তাঁরা মাত্র একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করতে গিয়েছিলেন। অল্পসংখ্যক মানুষ সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে সেখানে গোলযোগের আশঙ্কা কীভাবে থাকে? বা শহীদ মিনারে পরবর্তী সময়ে নীরব মানববন্ধনে কীভাবে নাশকতার আশঙ্কা থাকে? দশ-পনেরোজন মিলে একজনকে পেটানোর সময় মরিয়াম নামের ছাত্রীটি তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে কোন আশঙ্কায় তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়?

আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের লোক থাকতে পারে, তারা ইন্ধন দিতে পারে এই যুক্তিও হামলার পক্ষে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো আইনে কি লেখা আছে যে বিএনপি-জামায়াত করলে সে কোনো সমাবেশে বা আন্দোলনে যোগ দিতে পারবে না? বাংলাদেশের কোনো আইন বা কোথাও এটি লেখা নেই।

কোনো সমাবেশে কারও হাতে অস্ত্র বা বিস্ফোরক থাকলে তাকে নাশকতার ইন্ধন বলা যেতে পারে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বরাবর সমাবেশ করেছেন বঙ্গবন্ধু আর প্রধানমন্ত্রীর ছবি আর জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে। এসব কি নাশকতার ইন্ধন?

২.

গোটা আলোচনায় এটি স্পষ্ট যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের ওপর যে হামলাগুলো ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ একতরফা এবং বেআইনি। সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আঘাতের ঘটনা ঘটেছে, যা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ।

কিন্তু তারপরও এই হামলার দায় ছাত্রলীগের একার নয়। আমাদের এটিও বিবেচনা করতে হবে, তাদের এসব গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ ক্যামেরার সামনে নির্দ্বিধায় করার সাহস কে বা কারা দিয়েছে। তাদের নির্বিচার হামলার ঠিক আগে আগে হয় পুলিশ আক্রমণের স্থান ত্যাগ করেছে অথবা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশ এই আক্রমণে কোনো বাধা দেবে না এটি না জানলে কীভাবে তাঁরা প্রকাশ্যে অস্ত্র উঁচিয়ে হামলা করেন? এটা তাঁদের কারা জানাতে পারে নিশ্চিতভাবে? এসব অপরাধ করার পরও ছাত্রলীগের কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, তঁাদের বিরুদ্ধে কেউ মামলা করার সাহস পায়নি, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নেননি। রাষ্ট্রের পুলিশ, গোয়েন্দা, আদালত এমন নিষ্ক্রিয় হয়ে যান কোন শক্তির দাপট বা হস্তক্ষেপে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসামান্য অবদান রেখেছে ছাত্রলীগ। এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনকে ওই
শক্তিই পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তর করছে। ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বর্বরতার ঘটনাগুলোর মূল দায়দায়িত্ব তাদেরই। 

৩.

দায়দায়িত্ব আমাদেরও আছে। আমাদের কেউ কেউ অতীতে ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলে বিভিন্নভাবে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন। অথচ এত বড় বর্বর আক্রমণের ঘটনাগুলোর পর আমাদের সেসব প্রখ্যাত মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীর অনেকে নিশ্চুপ রয়েছেন। দায় আমাদের এসব মৌসুমি বিবেকবানদেরও।

দায় রয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতিগুলোরও। এঁদের অনেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্রদের ঢল দেখে একে ন্যায়সংগত আখ্যায়িত করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েছেন। আজ সেই আন্দোলনের নেতাদের ওপর বর্বরোচিত হামলা ও হয়রানিমূলক মামলার পর তাঁরা নিশ্চুপ থেকেছেন, কেউ কেউ এমনকি শোচনীয় ও দায় এড়ানো বক্তব্য প্রদান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেই দিয়েছেন আঠারো বছরের ওপরের কারও দায়দায়িত্ব তাঁর নিজের। অথচ তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অভিভাবক হওয়ার কথা তাঁরই। আর আঠারো বছরের ওপরের ছাত্রদের পাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসমাজের দাঁড়ানোর মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছে এ দেশের বহু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

আশার কথা, বাম ছাত্রসংগঠনসহ কিছু মানুষ এই নৈরাজ্যকর সময়ে তবু প্রতিবাদ করেছেন, রাস্তায় নেমেছেন। একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা, তাঁদের চিকিৎসা দিতে বাধাদান ও হয়রানিমূলক মামলার প্রতিবাদ করা মৌলিক একটি মানবাধিকার। এই প্রতিবাদ না থাকার মানে হাতুড়ি আর রামদাকে মেনে নেওয়া, পুলিশ আর সরকারি ছাত্রসংগঠনের অনাচারকে মেনে নেওয়া, নিজেকে বিবেকবর্জিত বা পলায়নপর মানুষ হিসেবে ঘোষণা করা।

আমরা বেশির ভাগ সুবিধাভোগী মানুষ যদি এমন হয়ে যাই, তাহলে এই সমাজে শক্তিতন্ত্র আরও জেঁকে বসবে। এক অশুভ শক্তির প্রতিবাদ না করতে পারলে অন্য অশুভ শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর নৈতিক শক্তিও আমরা হারিয়ে ফেলব। 

৪.

কোটা সংস্কার আন্দোলন বৈষম্যমূলক ও দুর্নীতিবান্ধব একটি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্রদের আন্দোলন। সরকার এটি ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারলেই তা সবার জন্য মঙ্গলকর হতো। দেরিতে হলেও কোটা সংস্কারের জন্য সরকার কমিটি ঘোষণা করেছে। এই কমিটি গঠনকে আমরা স্বাগত জানাই।

কমিটির কাজ দ্রুত শেষ করে ন্যায়সংগতভাবে কোটা সংস্কারের পদক্ষেপ নিলে এই আন্দোলনের পেছনে অশুভ শক্তি আছে কি না, এ নিয়ে সরকারকে দুর্ভাবনায় থাকতে হবে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিলে ছাত্রসমাজের ক্ষোভ ও মনোবেদনাও বহুলাংশে হ্রাস হওয়ার কথা। আর আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে এটিও প্রমাণিত হবে যে এসব হামলার পেছনে সরকারের কারও কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে নির্বিচার হামলা নিয়ে বহু ক্ষত সমাজে তৈরি হয়েছে। গণমানুষের সংগঠন হিসেবে এটি আওয়ামী লীগের অবশ্যই উপলব্ধি করার কথা। আওয়ামী লীগ সরকারেরও উচিত সে অনুসারে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।

আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক