আবর্জনা থেকে জৈব সার

যে বস্তুকে মানুষ বর্জন করতে চায়, সেটাই বর্জ্য। এই সরল সংজ্ঞাকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়ে আমরা এতকাল আবর্জনাকে ‘আবর্জনা’ই মনে করে এসেছি। বর্জ্যও যে সম্পদ, সেটি আমরা বুঝতে চাইনি। সে কারণে আবর্জনা এখন বোঝা হয়ে বাস্তুতন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে বিপন্ন করে চলেছে। বিঘ্ন ঘটাচ্ছে জীবমণ্ডলের স্থিতাবস্থায়। বর্জ্য মোকাবিলা এখন পরিবেশ রক্ষার অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আশার কথা হলো, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করেছে। নবায়নযোগ্য জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে একটি সুখবর দিয়েছে মেহেরপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। তারা শহর পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে পরিবেশসম্মত আবর্জনা ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র (স্যানিটারি ল্যান্ড ফিল্ড) নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। এখানে পৌরসভার সব ময়লা-আবর্জনা এনে প্রক্রিয়াজাত করে জৈব সার উৎপাদন করা হবে। এতে একদিকে শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখা যাবে, অন্যদিকে উৎপাদিত কম্পোস্ট সার কৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে। ৩ একর জমিতে ২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু জৈব সার উৎপাদন করা হলেও পরবর্তী সময়ে এখান থেকে বায়োগ্যাস উৎপাদন করা হবে।

দেশের অধিকাংশ পৌর এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেকেলে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিনগুলো ময়লা-আবর্জনায় উপচানো থাকে। তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। পরিবেশ নোংরা হয়ে থাকে। পৌর কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে ময়লা সরিয়ে শহরের আশপাশের খাল বা খানাখন্দে ফেলে রাখে। সেখান থেকে নতুন করে আরও বিশদ আকারে জীবাণু ও দুর্গন্ধ ছড়ায়।

সমস্যাকে সমস্যা বলে আগে মেনে নিতে হবে; কতটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে তা মেনে নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর সমাধান নির্ভর করছে। একটা সময় ছিল যখন কাঁচা পায়খানাকে সমস্যা বলেই মনে করা হতো না। ফলে তখন যত্রতত্র খোলা জায়গায় কাঁচা পায়খানা বসানো হতো। মানুষ যখন সচেতন হয়েছে এবং সেটিকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে মেনে নিয়েছে, তখনই এর বিলুপ্তি ঘটেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও সে রকমের একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামর্থ্যের চেয়ে এর গুরুত্ব উপলব্ধিই এখন বড় বিষয়। আমাদের অধিকাংশ পৌরসভা এখন যে আর্থিক সামর্থ্য অর্জন করতে পেরেছে, তাতে তাদের সবাই মেহেরপুরের মতো হয়তো এত বড় প্রকল্প চালু করতে পারবে না; কিন্তু এই আদলে ছোট প্রকল্প করতে পারবে, তাতে সন্দেহ নেই।

যাঁরা কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরা জানেন রাসায়নিক সারের তুলনায় জৈব সার কত উপকারী। বাজারে জৈব সারের আর্থিক মূল্যও অনেক। পৌরবাসীর উচ্ছিষ্ট খাবার, পচা ফলমূল, গোবর, কসাইখানার বর্জ্য—ইত্যাদি সঠিকভাবে সংগ্রহ করে কম্পোস্ট সার উৎপাদন করতে পারলে সেটি কৃষি অর্থনীতিতে টেকসই ভূমিকা রাখবে। বর্জ্য নিয়ে সভ্য দুনিয়ায় এখন দুটো কথা খুব চালু আছে। প্রথমটি, ‘আজকের বর্জ্য আগামীকালের সম্পদ’। দ্বিতীয়টি, ‘আবর্জনাই নগদ অর্থ’। মেহেরপুর পৌরসভার মতো অন্য পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকেও এভাবে ভাবতে হবে। নইলে আবর্জনার তলে চাপা পড়বে সভ্যতা।