সুশাসনের জন্য চাই আতঙ্কমুক্ত প্রশাসন

দক্ষ, দেশপ্রেমিক ও নিরপেক্ষ সরকারি কর্মকর্তা একটি সফল রাষ্ট্রের সম্পদ। দেশপ্রেম নিজের ভেতরের জিনিস, কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে পারে না। দক্ষতা অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জনের বিষয়। নিরপেক্ষতা নির্ভর করে পারিপার্শ্বিক অবস্থার ওপর। যে পরিবেশে নিরপেক্ষতার মূল্য রয়েছে, সেখানেই শুধু নিরপেক্ষতা দেখানো সম্ভব। যেখানে নিরপেক্ষতা প্রদর্শন বিপজ্জনক, সেখানে কারও পক্ষে নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়। কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের বেতন-ভাতা পান জনগণের করের টাকায়। তাঁরা জনগণের কল্যাণে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটাই প্রত্যাশিত। রাষ্ট্রের ক্ষতি হয় বা জনগণের অকল্যাণ হয়, এমন কোনো কাজ তাঁরা কেন করবেন? তাঁরাই তো সরকারের হাত-পা, চোখ-কান।

গত শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জোরদার হলে সিভিল সার্ভেন্টরা গোপনে দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তবে অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করতেন না। তাঁদের অনেকে আশা করতেন, ক্ষমতা হস্তান্তর করে ইংরেজ চলে গেলে কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাবেন। স্বাধীনতার পর অনেকে পেয়েছেনও। মহাত্মা গান্ধী ও পণ্ডিত নেহরুর আস্থাভাজনেরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছেন।

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ শীর্ষ মুসলিম লীগের নেতাদের সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠতা ছিল, পাকিস্তানে সেই সব আমলাই বড় বড় পদ অধিকার করেন। ব্রিটিশ আমলের আইসিএসের মতো পাকিস্তানে সিভিল সার্ভিস ক্যাডার তৈরি করা হয়। কঠোর নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা নিযুক্ত হতেন। তাঁদের যোগ্যতাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় ছিল, অতীতের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা গুরুত্ব পেত না। তা না পাওয়াতেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন করা অনেকে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসে নিয়োগ পেয়েছেন। নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকেই অতীতের রাজনীতি ভুলে গেছেন। বিশ্বস্ততার সঙ্গে সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন।

জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে আমলাদের কেউ কেউ যোগাযোগ রেখেছেন। জনগণের স্বার্থে সেটা কোনো দোষের ব্যাপার ছিল না। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কয়েকজন সিএসপি অফিসার অভিযুক্ত হন। তাঁদের আমরা শ্রদ্ধার চোখে দেখি। কেউ যদি ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্র ও সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন, তা নিন্দনীয় শুধু নয়, অপরাধ। যে কারও যেকোনো ধরনের অপরাধে শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু গয়রহ সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখা অতি গর্হিত কাজ।

যেহেতু একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে, সেখানে নীতি-আদর্শের প্রশ্নে পক্ষ-বিপক্ষের ব্যাপার ছিল। তবে বাঙালির অভ্যাসবশত ভিন্নমতাবলম্বীদের খুঁজে খুঁজে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা হয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী নেতারা বিষয়টির দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। অযথা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যাতে হেনস্তা না হন, তা তাঁরা দেখেছেন।
একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। স্বাধীনতার পর সারদা পুলিশ একাডেমির প্রধান ছিলেন এ বি এম জি কিবরিয়া। বঙ্গবন্ধু পুলিশ একাডেমি পরিদর্শনে যাবেন। তখন আইজি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেক। উৎসাহী পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ আইজিকে বললেন, বঙ্গবন্ধুকে একটু স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার কিবরিয়া সাহেব মুসলিম লীগের নেতা নুরুল আমিনের মেয়েজামাই।

জনাব খালেক ছিলেন আমাদের অগ্রজতুল্য। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে তিনি যখন কিবরিয়া সাহেবের কথা বললেন, তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, কিবরিয়া যে নুরুল আমিন সাহেবের মেয়েজামাই তা আমি জানি। তাঁর সব জামাইকেই আমি চিনি। তিনি সারদা অনুষ্ঠানে গিয়ে কিবরিয়াকে সস্নেহে জানতে চাইলেন, তাঁর বউ-ছেলেমেয়ে কেমন আছে। এককথাতেই তাঁর সব শঙ্কা দূর হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু মানুষের মনস্তত্ত্ব ভালো বুঝতেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) অতীতের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গোপন তদন্তের সংবাদ দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমে এসেছে গত হপ্তায়। ওই সংবাদের পর কর্মকর্তাদের অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জো হয়েছে। গত মঙ্গলবার বিবিসি বাংলার অনলাইন সংস্করণে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) থেকে পাঠানো এক চিঠিতে জেলার স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার শিক্ষাজীবনের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও তাঁদের পরিবার বা নিকটাত্মীয়দের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার বিষয়ে অনুসন্ধান চালাতে। ২৭ জুনের ওই চিঠিতে ১ জুলাইয়ের মধ্যে একজন ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্ত করাতে বলা হয়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই গোপন তদন্তের খবরে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাঁদের এই ক্ষোভের সংগত কারণ রয়েছে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের আগেই তাঁদের পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়ে থাকে। চাকরির মাঝপথে কেন নতুন করে তদন্ত?

বঙ্গীয় সমাজে এ ধরনের তদন্তের কারণে কারও চাকরিজীবন শুধু নয়, জীবনটাই বিপন্ন হতে পারে এবং শুধু নিজের জীবন নয়, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির জীবন পর্যন্ত। সামাজিকভাবেও একজন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এই ধরনের তদন্ত যে কতটা বিপজ্জনক, তা ভুক্তিভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেন না।

যে কর্মকর্তার চাচাদের সঙ্গে বাড়ির সীমানা নিয়ে বিবাদ রয়েছে, তাঁর বাড়িতে গোয়েন্দা পুলিশ গিয়ে খোঁজ নিলে কী রকম তথ্য পাওয়া যাবে, তা অনুমেয়। গোয়েন্দা কর্মকর্তা গিয়ে হয়তো তাঁর চাচাকেই অফিসারটির অতীত সম্পর্কে জানতে চাইলেন। চাচা তাঁকে খাতির করে নিয়ে যাবেন বাজারে ঘোষের দোকানে। রসগোল্লা, চমচম খাইয়ে তিনি বলে দিলেন, যদিও আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু আমার ভাই রাজাকার ছিলেন। তা ছাড়া ওকে মাঝে মাঝে বাংলাভাইয়ের সহকারীর সঙ্গে সড়কের কদমতলায় আলোচনা করতে দেখা গেছে। তদন্ত কর্মকর্তার দোষ কী?

একজন নির্দোষ ও দক্ষ কর্মকর্তার চাকরিজীবনের সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল এক রিপোর্টেই। নির্বাচনের আগে ইউএনওদের আমলনামা পুনঃপরীক্ষার পরামর্শ যাঁদের মাথা থেকে বেরিয়েছে, তাঁরা সরকারের হিতার্থী, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে নির্বাচনের আগে এ রকম তদন্ত প্রকল্প অর্থবহ।

শুধু ইউএনওদের দিকেই বন্দুক তাক করতে হবে কেন? তাঁদের সমমর্যাদার সহকর্মীরা ছাড় পাবেন কোন যুক্তিতে। হতে পারে ইউএনও নির্বাচনের সময় দায়িত্ব পালন করেন, অন্যেরা করেন না।

আমাদের প্রজাতন্ত্রে উপরস্থ কর্মকর্তাকে যতটা না ভয়, তার চেয়ে বেশি ভয়ের কারণ ছাত্র-যুব নেতাদের। জাতির ভালো-মন্দ তাঁদের বেশি কেউ বোঝেন না। কে রাজাকার পরিবারের সন্তান, আর কে মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য, সে তদন্ত সরকার করার আগে তাঁরাই হাতেনাতে করে ফেলেন।

একই সঙ্গে খবর বেরিয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে রদবদল আসছে। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। ২০ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের পরিকল্পনা। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, দামি গাড়ির ব্যবস্থা, পদ না থাকলেও পদোন্নতি দিয়ে কর্মকর্তাদের আস্থায় রাখা কঠিন। মানুষ সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয় মর্যাদাকে। শঙ্কার মধ্যে অশান্ত মন নিয়ে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়।

ছাত্রজীবনে কে কোন রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, কার খালু বা মামাশ্বশুর বিএনপি-জামায়াতের নেতা, তা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার চেয়ে দেখতে হবে অফিসারটি দক্ষ ও সৎ কি না। তদন্ত করা দরকার বর্তমানে তিনি ঘুষ-দুর্নীতিতে লিপ্ত কি না। সপ্তাহে কয় দিন কর্মস্থলে থাকেন আর কয় দিন ঢাকার বাসায় ফ্যামিলি মেম্বারদের নিয়ে কাটান।

জনবান্ধব রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দক্ষ কর্মকর্তারাই সুশাসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারেন। সৎ-দক্ষ কর্মকর্তা ছাড়া সরকারের খুব ভালো উন্নয়ন প্রকল্পও বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সরকারের স্বার্থেই প্রশাসনকে রাখা দরকার আতঙ্কমুক্ত।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক