সার্বিক ও ক্ষুদ্র সব ব্যবস্থাপনাই গুরুত্বপূর্ণ

নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের
নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি করার প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের

ব্রিটেনের দুবারের প্রধানমন্ত্রী (১৯৪৫-৫০, ১৯৫১-৫৫) এবং বিশ্বের অন্যতম স্টেটসম্যান বলে খ্যাত সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী স্যার উইনস্টন চার্চিলের গণতন্ত্র সম্পর্কে একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে এ লেখার বিষয়ের অবতারণা করছি। তিনি বলেছিলেন, একজন ছোটখাটো মানুষ হাতে ছোট পেনসিল নিয়ে ছোট একটি ভোটকক্ষে ছোট একটি ব্যালটে ছোট একটি দাগ দিয়ে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জানান, গণতন্ত্রের ভিত রচনা করেন।

চার্চিলের উক্তিতে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো গণতন্ত্রের মূলে একটি মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার। সঠিক ভোট প্রদান এবং প্রত্যেক ভোটারকে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানের নিশ্চয়তাই গণতন্ত্রের অন্যতম মূলমন্ত্র। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদানকে মানবাধিকারের অন্যতম উপাত্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে এ সনদে স্বাক্ষরকারী। কাজেই প্রত্যেক ভোটারের
নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি করা প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব। ভোটাধিকার নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব রাষ্ট্রের অন্যতম সাংবিধানিক, স্বাধীন এবং সর্বপ্রকার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের।

সংবিধান ও সংবিধানের আলোকে প্রণীত নির্বাচনী আইন বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা প্রদান করেছে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার, আইনের আলোকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীনভাবে বিধি প্রণয়ন করার, এমনকি নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপনও আইনের ও বিধির ক্ষমতাসম। উপমহাদেশের অনেক দেশ বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের মতো আইনের আওতায় এককভাবে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। কাজেই বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন আইনের ও বিধির দিক থেকে শক্তিশালী বলা যায়।

এত ক্ষমতা সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়োগিক ক্ষেত্রে শক্ত ভিতে যেমন দাঁড়াতে পারেনি, তেমনি কার্যকরও হতে দেখা যায় না। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন মুখ্য। হয়তো এর পেছনে অন্য পারপার্শ্বিক কারণ থাকতে পারে, তবে দৃশ্যত নেতিবাচক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া ক্রমেই জটিলতা সৃষ্টির কারণে কমিশনের কার্যক্রমের ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। এ ধরনের প্রভাব ঠেকাতে সময় সময় নির্বাচনী আইন ও বিধির সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অতীতে আইন সংস্কারে প্রতিটি নির্বাচনের বিশ্লেষণলব্ধ নেতিবাচক দিকগুলোকে প্রতিহত করতে সংযোজন করা হয়েছে নতুন নতুন ধারা। তবে ধারা যুক্ত করেই নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সম্ভব নয়। প্রয়োজন এসব ধারা ও আইনের কঠোর প্রয়োগ।

আমাদের দেশে বিগত কিছু বছরে নির্বাচনী আচরণে ব্যত্যয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং অনেকাংশে নির্বাচন কমিশনের আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। ক্রমেই জটিল হয়ে উঠেছে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা। প্রতিটি নির্বাচন নির্বাচন কমিশনকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করছে। এসব চ্যালেঞ্জ আগেও ছিল, তবে ইদানীং, বিশেষ করে গত কয়েক বছরে চ্যালেঞ্জের মাত্রা বাড়ছে। এসব চ্যালেঞ্জ–
উপসর্গ নির্ণয় করতে প্রয়োজন অতীত ও হালে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করা এবং তার প্রতিকার খুঁজে পাওয়া—যার মধ্যে রয়েছে নির্বাচনী ক্ষুদ্র বা মাইক্রো ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো। দুঃখজনক হলেও সত্য যে হালে কয়েকটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় তেমন দেখা যায়নি।

যেহেতু বাংলাদেশের নির্বাচন-প্রক্রিয়ার কারণে প্রতিযোগিতা প্রধান দুটি দলের, অর্থাৎ সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যেই হয়ে আসছে, সে কারণে বৃহত্তর সংখ্যার ভোটাররাও দুই দল বা কথিত জোটের মধ্যেই বিভক্ত। বাস্তবতার নিরিখে বর্তমানে বাংলাদেশের নিবন্ধিত ও নিবন্ধনপ্রয়াসী রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়া ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ক্ষমতাও অন্যান্য দল রাখে না। এমনকি এ বাস্তবতার ছাপ দেখা যায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও, যা এখন দলীয় পতাকাতলেও অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ কারণেও জটিল সমস্যা তৈরি হয়। নিরপেক্ষ অথবা বৃহত্তর ভোটারদের সামনে খুব একটি বিকল্প থাকে না।

ওপরের আলোচনায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব পড়েছে। গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, সরকারি দল নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় দুটি ভাগ রয়েছে। একটি অংশ সার্বিক এবং অপরটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনা। উভয় ক্ষেত্রেই নির্বাচনী আইন, প্রচলিত ব্যবস্থাপনা ও প্রয়োগের বিষয়গুলো বিস্তারিতভাবে আইন, বিধি ও পরিপত্র দ্বারা বিধৌত রয়েছে। গত নির্বাচনগুলোতে নির্বাচন কমিশন ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে এবং এগুলোকে চিহ্নিত না করলে আগামী নির্বাচনগুলোর ওপর—যার মধ্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন রয়েছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্নবোধক চিহ্ন উঠবে।

হালের নির্বাচনী ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনায় যেসব ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম নির্বাচনী এজেন্ট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গুরুতর অভিযোগ ক্রমবর্ধমান। দৃশ্যত এসব অভিযোগ নির্বাচন কমিশন আইনগত ও যৌক্তিকভাবে খণ্ডন করতে অথবা এ ধরনের অভিযোগ আমলে নিয়ে প্রতিকারের পদক্ষেপ নিতে পারছে না।

একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে হলে আইনানুগভাবে এবং প্রয়োজনে যেসব পদক্ষেপ নিতে হয়, তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো প্রতি বুথে প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দেওয়া। সাধারণত ওই এলাকার কর্মীদের মধ্য থেকে প্রার্থীর পক্ষে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে পারবেন, এমন ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ দেওয়া। পোলিং এজেন্ট নির্বাচনী ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনার উপাত্ত হলেও এজেন্ট না থাকার কারণে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকে না। পোলিং এজেন্টের অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনের করণীয় অত্যন্ত গুরুত্বের বিধায় গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ ১৯৭২-এর অনুচ্ছেদ ২২ ও ২৩-এ বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

ওপরের ওই ধারা মোতাবেক নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বও রয়েছে। অনুচ্ছেদ ২৩-এর প্রভিশনে বর্ণিত রয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে যে ভোট গ্রহণের সময়ের আগে পোলিং অফিসার অবশ্যই দেখবেন যে সব প্রতিযোগী প্রার্থীর নির্ধারিত এজেন্ট উপস্থিত রয়েছেন কি না? যদি কোনো প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট হাজির না থাকেন, তবে প্রিসাইডিং অথবা পোলিং অফিসার যথাসম্ভব কারণ খুঁজে বের করবেন এবং এর বর্ণনা নির্ধারিত ছকে লিখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, রিটার্নিং অফিসার এবং যথাযথ মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনকে জানাতে হবে। এমনকি পোলিং এজেন্ট যদি মাঝপথে বুথ ত্যাগ করতে চান, তা পোলিং অফিসারকে জানাতে হবে এবং তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি নথিভুক্ত করবেন। এমনকি বিস্তারিত নির্দেশাবলি নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়েলেও সংযুক্ত করা রয়েছে।

এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ২০০১ ও ২০০৮ সালে বর্ণনা করা হয়েছিল। এসব আইন ও বিধিতে নির্ধারিত পোলিং এজেন্টের তালিকা এবং তালিকার ভিত্তিতে রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক ছবিসহ পরিচয়পত্র প্রদানের কথা থাকলেও ইদানীং সর্বক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় হতে দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পোলিং এজেন্ট যেমন পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখেন না অথবা নেন না, বরং নিজস্ব দলীয় প্রতীকের ব্যাচ লাগিয়ে পোলিং এজেন্টের ভূমিকা পালন করেন। এ আচরণ আইন ও আচরণবিধির পরিপন্থী। কোনো রিটার্নিং অফিসার অথবা পোলিং অফিসারকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বা তথ্য পাওয়া যায়নি।

নির্বাচনী এজেন্ট এবং পোলিং এজেন্টদের দায়িত্ব  নিজ নিজ প্রার্থীর প্রতি হলেও নির্বাচন কমিশনেরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে প্রথম জানতে হবে যে একজন প্রার্থী প্রতি বুথে নির্বাচনী এজেন্ট নিয়োগ করেছেন কি না। এ তথ্য অবশ্যই সহজলব্ধ। কারণ, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পরিচয়পত্র এবং সব তথ্য ভুক্ত না করে পোলিং এজেন্টকে বুথে যেতে দেওয়া হয় না। অপর দিকে প্রার্থীর দায়িত্ব রয়েছে সঠিক এজেন্ট নিয়োগ এবং তাঁর কর্তব্য বুঝিয়ে দেওয়া।

নির্বাচন কমিশন এজেন্টদের উপস্থিতি নিয়ে যে অভিযোগ, তা সহজেই তদন্ত করতে পারবে, যদি আইন ও বিধি মোতাবেক এজেন্টদের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি অথবা পোলিং বুথ ত্যাগ করার বিষয়গুলো নির্ধারিতভাবে নথিভুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক দলের দাবি অবশ্যই নথির আলোকে খতিয়ে দেখতে হবে।

অতি সংক্ষেপে এজেন্ট নিয়ে বিবাদের বিষয়ে আলোচনা করার কারণ হচ্ছে, এ ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনা নির্বাচন কমিশন কতখানি গুরুত্ব নিয়ে দেখে, তা নির্ণয় করা। এসব ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনার ব্যত্যয়ও অবশ্যই আইনিভাবে চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

ইদানীং এ ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উদাসীনতার প্রবণতা বেশ দৃশ্যমান। নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনার ওপর অবশ্য গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে বিভিন্ন প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট এবং মাঠপর্যায়ে এজেন্টদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। অপর দিকে প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলেরও দায়িত্ব রয়েছে নিজেদের এজেন্টদের দায়িত্ব ও অধিকার সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেওয়া।

উপসংহারে উল্লেখ করতে চাই যে নির্বাচন কমিশনকে নিয়োজিত এজেন্টদের নিরাপত্তা বিধান করার পন্থা উদ্ভাবন করা উচিত, যাতে ভয়ভীতি দেখিয়ে এজেন্টদের দূরে রাখা অথবা বুথ থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনা হ্রাস করা যায়। প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট এবং পোলিং এজেন্টদের আইনানুগ করণীয়, দায়িত্ব ও অধিকারের সমন্বয় করে আলাদাভাবে ‘হ্যান্ডবুক’ তৈরি করে বিতরণ করার পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সার্বিক এবং ক্ষুদ্র সব ব্যবস্থাপনাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার, কাজেই ক্ষুদ্র ব্যবস্থাপনাকেও কোনোভাবেই অবহেলা করার সুযোগ নেই।

এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক