বিশ্ববিদ্যালয়ে মানবিক পরিবেশ জরুরি

চলতি বছরের শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আন্দোলন, পাল্টা মারধর, হয়রানি, হুমকি—এসব কারণে এই অস্থিরতা। শিক্ষার্থীরা তাদের যৌক্তিক দাবি নিয়ে আন্দোলন করবে, সেটিই কাঙ্ক্ষিত। সেই দাবিদাওয়ার একটি ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। সারা দেশে এই কোটা সংস্কারের আন্দোলন চলছে চার মাসের অধিক সময়জুড়ে। এই আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই ঘটেছে নানা ঘটনা। আন্দোলনটি দেশজুড়ে হলেও এর মূল কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। নেতৃত্বেও আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী। এ কারণে এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। আন্দোলন, ক্ষমতাসীন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের মারধর, নিপীড়ন, উপাচার্যের বাড়িতে হামলা, হলে হলে নেতাদের টহল ও হুমকি প্রদান, কবি সুফিয়া কামাল হলে গুজবকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা—সবই এই আন্দোলনের অংশ। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ভয়, নিরাপত্তাহীনতা হয়েছে নিত্যদিনের সঙ্গী।
বাংলাদেশে শারীরিকভাবে মারধর করে, হেনস্তা করে, ভয় দেখিয়ে, জলকামান নামিয়ে, পিপার স্প্রে ছিটিয়ে, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে কিংবা লাঠিপেটা করে আন্দোলন প্রতিহত কিংবা দমানোর কৌশল অতি পুরোনো। একসময় এগুলো কেবল পুলিশ বাহিনীই করত। এরশাদের আমলেও হয়েছে, তখন সেটি ছিল ‘স্বৈরাচারী’ সরকার। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে ‘গণতন্ত্র’ আসার পর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন দিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করার কৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনগুলো অনেক দিন থেকে চর্চা করে আসছে। কিন্তু এই দম বন্ধ হয়ে যাওয়া অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দুর্বলতা ও দেউলিয়াপনাকেই প্রকাশ করে।
গত কয়েক দিনের অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের ওপর ‘আন্দোলনের বারোটা বাজানোর’ ভার দিয়েই নিশ্চিন্তে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কেননা, যেখানে সব মানুষই মিডিয়ার কল্যাণে দেখছে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তারা ‘কিছু জানে না, শোনেনি’—এ ধরনের বক্তব্য প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। মোটের ওপর প্রশাসনের দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষকদেরও মনে রাখা প্রয়োজন, মূলত তাঁরা শিক্ষক।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা যে শুধু বইয়ের জ্ঞান দিয়েই শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ তৈরি করি তা নয়, আমাদের একটি বড় চেষ্টা এবং চাওয়া থাকে শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষার মানবিক পরিবেশ তৈরি করা। তাই শিক্ষক হিসেবে আমি নীল, সাদা কিংবা গোলাপি, যাঁর সঙ্গেই মতাদর্শিকভাবে থাকি না কেন, আমাদের কাছে বিবেচ্য হওয়া দরকার ছাত্র–ছাত্ররা আরেক দল ছাত্রকে কেন মারছে? কিংবা একজন সহপাঠী আরেকজন সহপাঠীর গায়ে হাত তুলছে কেন? বিশ্ববিদ্যালয় যদি একটি পরিবার হয়, সেই পরিবারের কর্তাব্যক্তিরা চাইবেন সেই পরিবারের সব সদস্য যেন মিলেমিশে চলতে পারে সেটির দিকে নজর রাখা, কিন্তু আমরা ভিন্ন চিত্র দেখি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ঈদের আগে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় একধরনের সমাধান হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল সংস্কারের, বাতিলের নয়। তবে আন্দোলনে কিছুটা অচল হয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় কিছুটা আড়মোড়া ভাঙলেও আন্দোলনে স্বস্তি মেলেনি। পরবর্তী সময়ে সংসদে কোটা প্রসঙ্গে সাংসদ রওশন এরশাদের বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর বাহবা এবং কোটাবিষয়ক নতুন কোনো প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়া আন্দোলনে আবার নতুন মাত্রা যোগ করে। তাই আমরা দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দিনই কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা নতুন কর্মসূচিতে যায়। সেদিন ছিল ১ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭তম জন্মদিন। সেই দিনেই শুরু হয়
প্রথম হামলা।
এই হামলার বিষয়ে প্রশাসনের কোনো রকমের প্রতিক্রিয়া না থাকায় জনমনে এ ধারণা জন্মানো অবিবেচনাপ্রসূত হবে না যে এতে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ অনুমোদন না থাকলেও ‘না দেখা’ কিংবা ‘না জানার’ অভিপ্রায় ছিল। আশার কথা এই যে নীল দল সমর্থন করা শিক্ষকেরাও তাঁদের সামনে ছাত্রলীগের নেতাদের হাতে মার খাওয়া ছাত্রদের বাঁচাতে গিয়েছেন। কারণ, শিক্ষক হিসেবে আমরা অনেকেই এই ধারণা পোষণ করি যে আমাদের প্রথম মনোযোগের জায়গা আমাদের শিক্ষার্থীরা। সেই শিক্ষার্থীরা যদি আক্রান্ত হয়, আমাদের প্রথম দায়িত্ব তাদের রক্ষা করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। শিক্ষার্থীরা চেয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার আলোকে প্রজ্ঞাপন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল জায়গা থেকে অস্পষ্ট বক্তব্য ও কোটা সংস্কারের জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে গড়িমসি অনাস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব সংবাদ দেশবাসীকে উদ্বিগ্ন করছে। এই আন্দোলনে ছাত্রলীগের আক্রমণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুলের পা ভেঙে গেছে। গরিব কৃষক বাবার সন্তান কোটা সংস্কার চাওয়ায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তার পা ভেঙে দিয়েছেন।
মারধর ও গ্রেপ্তারের ভয়ে আছে কোটা আন্দোলনকারীরা। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকেই যদি ক্যাম্পাসের ‘দেখভাল’ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার কথা। আন্দোলনকারীরা আন্দোলন করবে, এটা তাদের অধিকার। তারা ভুল পথেও ধাবিত হতে পারে। শিক্ষক হিসেবে আমাদের কাজ তাদের সঙ্গে যত বেশি সম্ভব যোগাযোগ রাখা এবং তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার পথ নিয়ে ভাবা। কিন্তু এর বিপরীতে যদি তাদের ‘ডান্ডা মেরে ঠান্ডা’ করার পথ অবলম্বন করি এবং সেটি অন্য কয়জন ছাত্রের ওপর ন্যস্ত করি, তাহলে আমরাই আসলে শিক্ষার্থীদের অমানবিক হতে শেখাচ্ছি এবং এই ক্ষেত্রেও আমাদের দায় নিতে হবে। যে ছাত্র আজকে তার সহপাঠীর গায়ে হাত তুলছে (সে নারী হতে পারে, পুরুষ হতে পারে), সেটি যদি আমার কাছে সহনীয় হয়, আমি গ্রহণ করি, সেই শিক্ষার্থী কাল আমার গায়ে এবং অন্যদের গায়ে হাত তুলবে। কারণ, আমি তার এই চর্চাকে অনুমোদন দিয়েছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর ওপর নিপীড়নে প্রশাসনিক আশকারা অনৈতিক ও অমানবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য আমরা যত বেশি মানবিক হতে পারব, আমাদের শিক্ষার্থীরা তত বেশি মানবিক হয়েই তৈরি হবে, আর শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সেই পরিবেশটি
নিশ্চিত করা।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]