তিন সিটিতে নির্বাচন

তিন সিটি করপোরেশনের আসন্ন নির্বাচনে খুলনা ও গাজীপুরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের তর্কিত প্রক্রিয়ার ছাপ কতটা পড়বে, সেটা দেখতে দেশের মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ থাকবে। তবে যেটা উদ্বেগজনক তা হলো, নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য অনিয়ম প্রতিরোধে কার্যকর কিছু করতে পারবে—এমন ভরসা নাগরিক-মনে প্রতিষ্ঠিত নয়। কারণ, ইসি ইতিমধ্যে প্রমাণ দিয়েছে যে তারা সব ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ সুরক্ষায় বেশ সতর্ক ও যত্নশীল। বিরোধী দলের কোনো অধিকার রক্ষার প্রশ্ন এলে তাদের কমজোরি মনোভাব অপেক্ষাকৃত বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সিলেটে মনোনয়নপত্র জমাদানের দিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রায় পাঁচ শ মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন করেছেন, যা ছিল বিধিবহির্ভূত। কিন্তু ইসি বা জনপ্রশাসনকে এ নিয়ে টুঁ–শব্দ উচ্চারণ করতে দেখা যায়নি। অনধিক পাঁচজন সমর্থক নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার বিধান থাকলেও সিলেটে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ‘আশপাশে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না’ অবস্থায় মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। অবশ্য কেউ পাল্টা যুক্তি দিতে পারেন, বরিশালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী নীরবে, অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী মোটর শোভাযাত্রাসহকারে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন। ইসি তো কোথাও কারও বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেনি।

সার্বিক বিচারে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রায় সারা দেশে প্রশাসনের তরফ থেকে একটা বিমাতাসুলভ আচরণের মধ্যে আছেন। রাজশাহীর প্রাক্‌–নির্বাচনী পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত অশান্ত না হলেও অভিযোগ উঠেছে, নতুন সাজানো মামলায় শনিবার থেকে বিএনপির ওয়ার্ড পর্যায়ের তিন নেতা ও নাশকতার মামলায় বিএনপির দুই কর্মীর অন্তরীণ ঘটেছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য এগুলো ভালো দৃষ্টান্ত নয়। গতকাল নির্বাচনী প্রচারাভিযানের প্রথম দিনে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে রাজশাহীকে শান্তি ও সম্প্রীতির শহরে পরিণত করার অঙ্গীকার করেছেন। আমরা তাঁর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এটা যে বাগাড়ম্বর নয়, তার প্রমাণ পেতে হলে মেয়র প্রার্থী থাকতেই আমরা দেখতে চাইব যে বিরোধী দলকে চাপে রাখার পুলিশি কৌশলকে তিনি কীভাবে দেখছেন বা সমর্থন করছেন কি না। বিরোধী দলের কেউ হলেই নির্বিচার বৈষম্যের শিকার হওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। এটা চূড়ান্ত বিচারে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি একটি হুমকি।

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি যে পুলিশ প্রশাসন দেশে একটি নির্বাচনকেন্দ্রিক ধরপাকড়ের ব্যবস্থা গড়ে তুলছে। এর মুখ্য বৈশিষ্ট্য হলো সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং তাঁর সমর্থকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার ঘটানো। নতুন নির্বাচনী ব্যাধি হলো ভোটকেন্দ্রে মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর নির্বাচনী এজেন্ট না পাওয়া। খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেলেও তাঁরা ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনী এজেন্ট নিশ্চিত করতে পারেননি। ভোটের দিন গাজীপুরে বিএনপির শতাধিক এজেন্টকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ অশ্রুতপূর্ব। আবার খুলনা ও গাজীপুরে যাঁরা নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে গ্রেপ্তার বা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি অভিযানের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা ইদানীং তা থেকে নিস্তার পেয়েছেন। এই কৌশলের কোনো ধরনের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। অথবা নতুন কোনো কৌশলে যাতে বিরোধী পক্ষকে ঘায়েল করার উদ্যোগ সরকার বা প্রশাসনের তরফে নেওয়া না হয়, সেদিকে নজর রাখাও নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব।

সব মিলিয়ে সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটাধিকার প্রয়োগের বিপরীতে যা চলছে, তাকে আর চলতে দেওয়া যায় না। নির্বাচনে অনিয়ম হচ্ছে অথচ এ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের যে নির্লিপ্ত অবস্থান ও ভূমিকা তা পরিস্থিতিকে হতাশাজনক অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তিন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি পাল্টাক সেটাই প্রত্যাশিত।