'তোরে মনে পড়ে, ভাই'

কাকে বলি যে এসে দেখে যাও আমরা কেমন করে বেঁচে আছি! কাকে বলি, এই কি মানুষজন্ম? কাকে বলি, যদি পারো লেখো আমাদের জাতীয় জীবনের বিষাদসিন্ধু। কারবালায় চালানো এজিদের নৃশংসতা প্রতিদিন ঘটে চলেছে বাংলাদেশে। আমাদের আপস করে নিতে হয়। ধর্ষকের সঙ্গে আপস করতে হয় ধর্ষণের শিকার মেয়ের পরিবারকে। ছেলের খুনিদের সঙ্গে আপস করতে হয় মাকে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা রাশেদ খান দুই দফায় ১৩ দিনের রিমান্ডে পড়ার পর তাঁর মা ফরিয়াদ করেন, ‘আমার মণিকে মাফ করে দাও, ভিক্ষা দাও।’ বেঁচে থাকাই এক বড় আপস। কিন্তু প্রাণপ্রিয় পুত্রকে হারিয়ে বা তাদের আহত-রক্তাক্ত চেহারা দেখেও যখন আপস করতে হয়, তখন কোন জাদুঘরে পাঠাব আমাদের সংবিধানকে? কার কাছে বিচার চাইবে মানুষ?

১০ জুলাই প্রথম আলো শিরোনাম করেছে, চাপে পড়ে ছেলের হত্যা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হন মা। পুরান ঢাকার ওয়ারী এলাকার ছেলে রাকিব। দুটি সিনেমায় অভিনয় করা শিশুশিল্পী সে। বাবা ব্যবসায় মার খেয়ে নিজে বসে পড়েন, আর ছেলেকে বসিয়ে দেন টং দোকানে। গত ৬ এপ্রিল রাতে এলাকা থেকেই রাকিবকে তুলে নেয় পুলিশ। রাতে থানায় ইচ্ছামতো পেটানো হয়। সকালে ছেলেটি মারা যায়। মায়ের অভিযোগ, লাশটিকে বাইরে নিয়ে গুলি করে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ার গল্প সাজানো হয়। মৃত্যুর পরও তার রেহাই মেলেনি। পা থ্যাঁতলানো, মাথা ফাটানো, রক্তাক্ত ছেলেটির লাশে গুলি করে আবারও সাজানো হয় ডাকাতের গুলিতে ডাকাত মারার কুখ্যাত গল্প।

অসংখ্য মায়ের করুণ কঠিন গল্প লেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। এই গল্পের রচয়িতা কোনো সাহিত্যিক নন, এই মর্মান্তিক গল্পগুলোর বাস্তব জন্ম দিয়ে চলেছে আমাদেরই দেশের একশ্রেণির ক্ষমতাবান মানুষ, যারা নাকি প্রতাপশালী, যাদের কারও কারও গায়ে থাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাক।

ছেলের খুনীদের সঙ্গে আপস করতে হলেও আল্লাহর কাছে বিচারের দাবি ছাড়েনি রাকিবের মা রীতা হাওলাদার। ছবি: প্রথম আলো।
ছেলের খুনীদের সঙ্গে আপস করতে হলেও আল্লাহর কাছে বিচারের দাবি ছাড়েনি রাকিবের মা রীতা হাওলাদার। ছবি: প্রথম আলো।

রাকিবের মা, যাঁর নাম রীতা হাওলাদার, তিনি ছেলে আটকের খবর পেয়ে সেই রাতেই থানায় হাজির হন। থানায় বসেই আরেক ঘরে শুনতে পান কিশোর পুত্রের চিৎকার। ১৫ বছর বয়সী ছেলের সেই মা, ওয়ারী থানার ওসির ঘরে গিয়ে দেখেন, ছেলেকে ন্যাংটো করে পেটানো হচ্ছে, লাথি মারা হচ্ছে। সারা গায়ে আঘাতে চিহ্ন, চোখটা বাঁধা। মায়ের করা মামলার এজাহারমতে, কিশোর নির্যাতনের নেতৃত্বে ছিলেন ওসি রফিকুল এবং ওসি (তদন্ত) সেলিম। এই গল্পে আরও নাম এসেছে, এসআই জাকির, এসআই জ্যোতিষ, দারোগা শাহ আলম প্রমুখ।

পরদিন ৬ এপ্রিল সকালে আবার থানায় যান রীতা হাওলাদার। বাকিটা তাঁর মুখ থেকেই শুনুন, ‘থানার গেটে পৌঁছে শুনি, লোকজন বলাবলি করছে, আহা রে, ছেলেটারে মাইরা ফেলাইছে। থানা এখন ধুইতাছে। মরাটারে জয়কালী মন্দিরের কাছে নিয়ে আবার ক্রসফায়ার দিছে।’ রীতা হাওলাদার থানায় গিয়ে ছেলের খোঁজ চান, তাকে খাবার দিতে চান। কিন্তু তারা বলে, রাকিব বলে কেউ নেই। মায়ের হাতে শেষ খাওয়াটাও খেতে পারেনি রাকিব।

রাকিব তো মরে গিয়ে একবারের জন্য পাওয়া জীবনের জ্বালা–যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু তার মায়ের শাস্তির সেটাই শুরু। তাঁর অপরাধ, তিনি ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে মামলা করেছিলেন। আসে এলাকাছাড়া করার হুমকি। ১৯ এপ্রিল বিকেলে এসআই জাকির হোসেনের নেতৃত্বে ৮ থেকে ১০ জন তাঁর বাসায় এসে কাগজে ও স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করতে বলেন। রাজি না হলে বাদী ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রীতার চোখে আঘাত লাগে। জোর করে সই নিয়ে যায়। আদালতের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে রীতা সেদিন বলেন, আসামিরা থানার দায়িত্বে থাকলে তাঁর পক্ষে আর মামলা চালানো কিংবা সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করা সম্ভব নয়। আদালত সব শুনেছেন, কিন্তু কিছু করতে পারেননি।

ছেলের মুক্তির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রাশেদের মা সালেহা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো
ছেলের মুক্তির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন রাশেদের মা সালেহা খাতুন। ছবি: প্রথম আলো

আদালত প্রাঙ্গণ থেকেও তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও হয়। কী করতে পারতেন তিনি? অবশেষে গত ১০ মে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন। কারণ, বড় বড় জায়গা থেকে চাপ এসেছে। রাকিবের নানা নিজে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি হয়েও সেই বড় বড় জায়গার পাথরে তৈরি মানুষের মন গলাতে পারেননি। বড় মাছ ছোট মাছ খেলে তার বিচার হয় না। আর মাছের মায়েদের পুত্রশোক করতে নেই; এই দেশে কত রাকিব জন্মায়, কত রাকিব অকাতরে মারা যায়। দেশ নাকি মা, সেই দেশমার্তৃকার কি শোক হয় না, রাগ হয় না? হয়। হয় বলেই আদালতের কাছে রীতা হাওলাদার বলেন, ‘রাকিবকে হত্যা করা হলেও’ আর মামলা চালাতে চাই না। মানুষের আদালতে বিচারের দাবি ছাড়তে বাধ্য করা হলেও আল্লাহর কাছে বিচারের দাবি তিনি ছাড়েননি।

আজকাল রাস্তাঘাটেও শুনতে পাই, মানুষ আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছে। কত অসহায় বোধ করলে মানুষ আইন-আদালত-রাজনীতি-রাষ্ট্র—সবকিছুর ওপর এভাবে আস্থা হারায়? পা ও মেরুদণ্ড হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দিলেও আপস, হত্যা করলেও আপস। আপস করে নিতে হয়েছে মাদকবিরোধী যুদ্ধে নিহত কমিশনার একরামের পরিবারকেও। খবরে জানা গিয়েছিল, অন্য কোনো একরামুল নামের মাদক ব্যবসায়ীর জানের বদলায় কমিশনার একরামুল নিহত হন। রাকিবের খবরেও প্রকাশিত হয়, পুলিশ ২২ বছর বয়সী ডাকাত রাকিবের জায়গায় ১৫ বছর বয়সী শিশুশিল্পী রাকিবকে ধরেছিল। ইচ্ছা করেই করুন বা ভুল করেই করুন, কেউ দায় স্বীকার করছে না। কারও কোনো বিকার হয় বলেও মনে হয় না। আমাদের ঝালকাঠির লিমনের কথা মনে আছে। নামের ভুলে তাকে ধরে পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। সেটা নিয়ে অনেক হইচই হয়—অবশেষে লিমন ছাড়া পায়। পায়ের বদলায় জীবন নিয়ে ফিরতে পারে। কিন্তু এখন বাংলাদেশ আরও উন্নতি করেছে, এখন সহজেই জান নিয়ে ফিরতে পারে না ‘টার্গেটে’ পড়া মানুষেরা। এই বাংলাদেশে জীবন জিয়ে না।

রাকিবের খবর পড়ে স্লেভেনীয় কবি ডেন জাইচের ‘নিষ্ফলা নবান্ন’ কবিতার কথা মনে পড়ে। কবিতাটি নিহত পুত্রের করোটির সাদা দাঁত দেখে ছেলের কঙ্কাল শনাক্ত করার থম ধরা যন্ত্রণা নিয়ে। সেই মায়ের হয়ে কথা বলছে মৃত ছেলেটির ভাই।

মায়ে কয়, আমি তার সুন্দর শাদা দাঁত দেইখা
মাথার খুলিটা চিনবার পারছি।
সুন্দর শাদা দাঁত
মাটিতে কামড় দিয়া আছে,
সুন্দর খয়েরি চোখগুলাও
ভইরা ছিল মাটিতে,
মজবুত শাদা হাড়গুলি
আগে তো হাতই আছিল,
যেই হাত দিয়া অয়ে কোনো মাইয়ারে আদর করে নাই।
এখন মাটিরে আদর করতাছে
অর মজবুত শাদা হাড়গুলি।
হের নূরের মতো কচি দাঁতগুলি
মাটির ভিতরে পোঁতা।
বসন্তে নবান্ন আনে এই জমিন।

এই পাষাণ কঠিন মাটি
তার আন্ধার চোয়ালে সবাইরে গিল্যা নেয়।
বুইড়া মাইনষের মরণ বেজায় কঠিন।
আরো কঠিন ওই সুন্দর চোখগুলির
ফসল গজানোর নবান্নের দিন,
চোখগুলা কোনো দিন উদাম মেয়েলোক দ্যাখে নাই।
কোনো মাইয়াও কোনোদিন
ফিশফিশায়ে চুমু খাইতে খাইতে অরে কয় নাই:
আমি তোমার
(ওই চোখ আসলে কিছুই দ্যাখে নাই)
ওই চোখ থাইকা কি গজাইব কিছু
নিষ্ফলা নবান্নের কালে এই পাষাণ মাটিতে?

তোরে মনে পড়ে, ভাই।
আমাগো মা তোর শাদা দাঁত চিনছিল
তোর দামাল সুন্দর দাঁত,
অপ্রসূতি পৃথিবীর নবান্ন ফসল।

অপঘাতে মারা যাওয়া এত মানুষের লাশগুলো মাটিতে মিশে যাবে। মানুষের দেহের নাইট্রোজেন মাটিকে উর্বর করবে। মৃত্যুগুলো বৃথা যাবে না। মরদেহগুলো মাটিকে উর্বর করতে থাকবে—এই আমাদের একটুখানি সুখ!

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]