বিজেপির সাইবার বাহিনী এখন বুমেরাং

বিজেপির সাইবার বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি সুষমা স্বরাজও
বিজেপির সাইবার বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাননি সুষমা স্বরাজও

জনসাধারণকে হিংসাত্মক কথাবার্তা এবং নৃশংস হামলার দৃশ্যে পোস্ট করতে দেওয়ার কারণে প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘৃণা ছড়ানোর বিষয়টি যে একটি বিরাট সমস্যা, তা ভারতের সবাই কমবেশি বুঝতে পারছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের একটি বক্তব্যকে ধরে তাঁর নিজের দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদ্‌গার করেছেন, তা বলার মতো নয়। টুইটারে জনগণের কাছ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবাসংক্রান্ত অভিযোগ শোনা এবং সেসব অভিযোগের জবাব দেওয়ার মাধ্যমে সুষমা ইতিমধ্যেই বিখ্যাত ও কুখ্যাত হয়ে উঠেছেন। তবে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের বহু নেতা-কর্মীর কাছে তিনি শত্রু হয়ে পড়েছেন।

স্বামী মুসলমান এবং স্ত্রী হিন্দু—এমন এক দম্পতি সম্প্রতি পাসপোর্টের আবেদন করেন। স্বামী ভদ্রলোককে সংশ্লিষ্ট একজন পাসপোর্ট কর্মকর্তা হিন্দু ধর্মে দীক্ষিত হতে বলেন; অন্যথায় পাসপোর্ট দেওয়া হবে না বলে হুমকিও দেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। পাসপোর্ট কর্মকর্তাকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়। এরপরই সুষমা স্বরাজকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণ করা হয়। পাসপোর্ট কর্মকর্তাকে যখন বদলি করা হয়, তখন সুষমা দেশের বাইরে ছিলেন। তারপরও বিজেপির গোঁড়া কর্মী-সমর্থকেরা সুষমার বিরুদ্ধে ঘৃণাসূচক টুইটের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। তাঁরা সুষমাকে ‘বেগম’ আখ্যা দিয়ে তাঁকে বেধড়ক পেটানোর জন্য তাঁর স্বামীকে অনুরোধও করেছেন।

হিন্দু মৌলবাদের প্রসার, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো এবং বিরোধী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ভয়ানক আক্রমণের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দেওয়ার জন্য গত এক দশকে বিজেপি একটি শক্তিশালী সাইবার বাহিনী গড়ে তুলেছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে কোণঠাসা হওয়ার কারণে বিজেপি বিরোধী দলে থাকার সময়ই এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর তারা তাদের রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া ট্রলকে সামনে নিয়ে আসে।

বিজেপির এই সাইবার বাহিনী এখন টুইটার, ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত স্বাতী চতুর্বেদীর বই আই অ্যাম আ ট্রল: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওয়ার্ল্ড অব বিজেপি’স ডিজিটাল আর্মিতে দেখানো হয়েছে বিজেপি কীভাবে ভারত ও ভারতের বাইরে প্রচুর অর্থ খরচ করে এক শক্তিশালী সাইবার বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই বেতনভুক সাইবার যোদ্ধারা মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনীতিকদের ‘সিকুলার’ (সেক্যুলার/ধর্মনিরপেক্ষ), ‘লিবটার্ডস’ (লিবারেল/উদার), ‘খানগিরিস’ (কংগ্রেসি) ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে সারাক্ষণ ঘৃণা ছড়ানো পোস্ট দিতে থাকে। বিজেপির স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, এমন যেকোনো বক্তব্য দিলে এই বাহিনী এমন অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করে, যা ভদ্রভাষায় মোকাবিলা করা অসম্ভব। নিয়মিত আমাকে এ ধরনের অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়।

বিজেপির নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের একজন হিসেবে সুষমা স্বরাজকে এর আগে কোনো দিন তাঁর দলের সাইবার বাহিনীর ট্রলের শিকার হতে হয়নি। এ অবস্থার মুখে পড়ে তিনি দ্রুতই একটি টুইটার জরিপ করেছেন। চমকে ওঠার মতো ব্যাপার হলো জরিপে দেখা গেছে, ৪৩ শতাংশ লোক সুষমাকে ট্রল করার পক্ষে। এর সঙ্গে সুষমা আরও যেটি জানতে পেরেছেন, তা আমরা অনেক আগে থেকেই জানি। সেটি হলো তাঁর দলটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনভাবে বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে কেউ ঢুকলে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়বে। বিজেপির এই সাইবার বাহিনীকে নেতারা খাইয়ে-পরিয়ে বড় করে তুলেছেন। সেই বাহিনী এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দৈত্যের মতো বিজেপির নেতাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এখন তারা নেতাদেরও আক্রমণ করতে পিছপা হচ্ছে না।

লক্ষণীয় ব্যাপার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মী বাদেও নারীরা বিজেপির ট্রলের শিকার হচ্ছেন বেশি। তারা নিয়মিতভাবে নারী অধিকারকর্মীদের ধর্ষণের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বিজেপির এক কর্মী কংগ্রেস পার্টির নারী মুখপাত্রের টুইটার পেজে গিয়ে তাঁর ১০ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করার হুমকি দিয়েছেন। যদি এই হুমকিদাতাকে গ্রেপ্তার করা হতো, তাহলে সাইবার হুমকিদাতারা সতর্ক হয়ে যেত। কিন্তু সরকারের দিক থেকে তাদের ঠেকাতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও ‘ভুয়া খবর’ গুরুতর সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। গুজবগুলো এখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে সওয়ার হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। শিশু পাচার ও গরু জবাইয়ের গুজব ছড়িয়ে এখানে এ পর্যন্ত বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু গত বছরই ভারতে ৯টি রাজ্যে এ ধরনের কমপক্ষে ১৫টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় লোক মরেছে ২৭ জন।

মিয়ানমারে সাইক্লোনের আঘাতের শিকার হওয়া কিছু মানুষের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করে কোনো একটি গোষ্ঠী প্রচার করেছে, এরা সবাই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার মুসলমান। তাদের ওপর স্থানীয় ভারতীয়রা নির্যাতন করেছে। এই ছবি দেখে মুসলিম আন্দোলনকর্মীরা ঘোষণা দিয়ে বসেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার লোকদের ভারতের অন্য যে শহরে যে অবস্থায় পাওয়া যাবে, সেখানে সে অবস্থায় তাদের ওপর আঘাত হানা হবে। এই ছবিগুলো যে ভুয়া, তা সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করার আগেই বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের মানুষ প্রাণভয়ে চাকরিবাকরি ও ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বৈশিষ্ট্যগত কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঝড়ের গতিতে তথ্য ছড়িয়ে দেয়। তথ্য ভুল নাকি সঠিক, তা বাছবিচার করে না। এমনকি যখন আসল সত্য বেরিয়ে আসে, তখন মিথ্যা তথ্য যে গতিতে ছড়িয়েছিল, আসল খবর সে গতিতে ছড়ায় না। এই সমস্যার কোনো সহজ সমাধান নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে নতুন সমস্যা দেখা দেবে। সেটি করতে গেলে বাক্‌স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের একটি বিরাট অজুহাত পেয়ে যাবে সরকার। তবে এখন বিজেপি নিজেই যখন তার তৈরি করা দানবের আক্রমণের শিকার হয়েছে, তখন এটিকে তারা সমস্যা হিসেবে মেনে নিলেও নিতে পারে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী