বাংলাদেশের সোনা জয়

শূন্য বা জিরোর জন্ম হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকে। শূন্যের আবিষ্কর্তা আর্যভট্টের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে খোদ আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘ভারতীয়দের কাছে আমাদের ঋণ অনেক। তারা আমাদের গুনতে শিখিয়েছে।’ কালের স্রোতে ভারতবর্ষ তিন টুকরো হয়েছে। সেই তিন টুকরোর এক টুকরো বাংলাদেশ এতকাল পর প্রমাণ করতে পেরেছে আর্যভট্ট, ভাস্করাচার্য, শ্রীনিবাস রামানুজনের মতো নমস্য গণিতবিদদের উত্তরাধিকারের পীঠস্থান হবে এখানেই। সেই সম্ভাবনার ঝিলিক দেখা গেছে রোমানিয়ার ক্লুজ-নাপোকা শহরে আয়োজিত ৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের (আইএমও) আসরে। সেখানে বিশ্বের সেরা সেরা গণিতবোদ্ধাকে পেছনে ফেলে সোনার পদক পেয়েছে বাংলাদেশ।

চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থী আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী বাংলাদেশকে এই সম্মান এনে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এ বছর আইএমওতে এটাই একমাত্র সোনা। এটি আইএমওতে দেশের জন্য প্রথম সোনার পদক। বাংলাদেশ দলের তিন সদস্য তাহনিক নূর সামিন, জয়দীপ সাহা ও তামজিদ মুর্শেদ রুবাব পেয়েছে ব্রোঞ্জ পদক। অপর দুই সদস্য রাহুল সাহা ও সৌমিত্র দাস সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ১০৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম।

উন্নত বিশ্বের শিক্ষা-দীক্ষার পরিবেশ, জীবনমান, সমাজ বাস্তবতা—ইত্যাদির সঙ্গে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের অবস্থা তুলনা করলে জাওয়াদ, সামিন, জয়দীপ, তামজিদ মুর্শেদ, রাহুল ও সৌমিত্রের এই পর্যায়ে উঠে আসা কম সাফল্যের কথা নয়। বিশেষ করে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র সোনাজয়ী জাওয়াদের সাফল্যে সবারই আনন্দে আত্মহারা হওয়ার কথা।

মনে রাখা দরকার, এই সাফল্য হুট করে আসেনি; একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় এসেছে। এটি দীর্ঘ ১৪ বছরের ক্রমাগত উৎকর্ষের ফল। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় ও প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর সারা দেশে গণিত উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। আর নির্বাচিতরা আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে যোগ দিচ্ছে ২০০৫ সাল থেকে। এই ১৪ বছরে বাংলাদেশের অর্জন একটি সোনা, ছয়টি রুপা ও ২২টি ব্রোঞ্জ পদক এবং ২৭টি সম্মানসূচক স্বীকৃতি।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে গণিতভীতি কাজ করে। হয়তো প্রচলিত মুখস্থবিদ্যাকেন্দ্রিক গণিতচর্চা এর বড় কারণ। শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড শিক্ষার্থীদের এই বার্তাই দিয়ে আসছে যে বিজ্ঞানের একটি মৌলিক অনুষঙ্গ হলো গণিত। গণিত যে মুখস্থের নয়, বরং এটি যে উপলব্ধির বিষয়; জটিল অঙ্ক ভেঙে যুক্তিনির্ভর উপস্থাপনায় দুরূহ সমস্যার সমাধান করতে পারাটাই যে গণিতের মোক্ষ, সেই বার্তাই তারা দিয়ে আসছে। তাদের সেই প্রচেষ্টার সুফল আসতে শুরু করেছে। সেই প্রচেষ্টা বাংলার খুদে গণিতবিদদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আর্যভট্ট-ভাস্করাচার্য-রামানুজনদের জাগিয়ে তুলবে; সেদিনের অপেক্ষায় আছে জাতি।