অভিবাসীদের বিশ্বকাপ বিজয়!

২০ বছর পর বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি আবারও ফ্রান্সের। কাল মস্কোর লুঝিনিকি স্টেডিয়ামে উঠল ফরাসি সৌরভের ঢেউ। লরিস-পগবা-এমবাপ্পেদের উচ্ছ্বাসটাও তাই হলো বাঁধভাঙা।  ছবি: রয়টার্স
২০ বছর পর বিশ্বকাপের সোনালি ট্রফি আবারও ফ্রান্সের। কাল মস্কোর লুঝিনিকি স্টেডিয়ামে উঠল ফরাসি সৌরভের ঢেউ। লরিস-পগবা-এমবাপ্পেদের উচ্ছ্বাসটাও তাই হলো বাঁধভাঙা। ছবি: রয়টার্স

অনেকেই এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের পরাশক্তিগুলোর বিদায়ে আনন্দিত হয়েছিলেন এই আশায় যে বিশ্বকাপ ফুটবল ২০১৮-তে নতুন কোনো শক্তির উত্থান ঘটবে। দুর্বলের কাছে শক্তিমানের পরাজয়ও তাই অনেক সময়েই তাঁদের আনন্দ দেয়, যাঁরা নিজেদেরও দুর্বলের কাতারে গণ্য করে থাকেন। এবারের বিশ্বকাপের আসরে তেমনটিই ঘটছিল। কিন্তু পরাশক্তির মধ্যে ব্যতিক্রম হয়ে রইল ফ্রান্স। ফ্রান্সের সাফল্য উদ্‌যাপনে তাই অনেকেই কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত।

ঢাকার তিন ভাগের এক ভাগ জনসংখ্যার দেশ ক্রোয়েশিয়ার সাফল্য দেখতে চাওয়ার আগ্রহের পেছনেও সে রকম একটা মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে সন্দেহ নেই। তবে ফ্রান্সের এই সাফল্য প্রচলিত অর্থে কোনো ইউরোপীয় পরাশক্তির বিজয় নয়; বরং এটি হচ্ছে অভিবাসীদের বিজয়, যাঁরা দেশটিতে অনেকটাই পরবাসী, একঘরে, বর্ণবাদের শিকার। ক্রোয়েশীয় ফুটবলের একজন কর্মকর্তার ভাষায়, তাঁর দেশের বিরুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে বহুজাতিক ফ্রান্স।

পাশ্চাত্যজুড়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে যখন অভিবাসনবিরোধী বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, তখন ফরাসি ফুটবল দলের ছবি পুরো ফ্রান্স ও ইউরোপকে মনে করিয়ে দেবে যে এই অর্জনে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর অবদানই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তুর্কি দৈনিক সাবাহর হিসাবে বিশ্বকাপে ফরাসি দলের হয়ে যাঁরা খেলেছেন, তাঁদের ৭৮ শতাংশই হচ্ছে অভিবাসী। এবারের বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে ফ্রান্স দলেই অভিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আবার এই অভিবাসীদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই মুসলমান। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে চারটি গোলের আত্মঘাতীটি ছাড়া অন্য তিনটির মধ্যে দুটি করেছেন পল পগবা ও এমবাপ্পে। পগবার জনকরা এসেছেন গিনি থেকে, আর এমবাপ্পের মা আলজেরীয় ও বাবা ক্যামেরুনের। পগবা, কন্তেসহ দলে ছয়জন ছিলেন মুসলমান।

অভিবাসন, বিশেষত মুসলমান অভিবাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপে বর্তমানে যে রাজনৈতিক হাওয়া উঠেছে, তার সূত্রপাত কিন্তু ফ্রান্সেই—মেরি লোপেনের দল ন্যাশনাল ফ্রন্টের উত্থানের মাধ্যমে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই বর্ণবিদ্বেষী দল দ্বিতীয় এবং তার আগের নির্বাচনে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। আর এই দলের রাজনীতি মোকাবিলায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফ্রান্সের মূলধারার ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় দলই অভিবাসনবিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটিতে মুসলমানরা আগে যেসব ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতেন, সেগুলোর বেশ কয়েকটিই তাঁরা হারিয়েছেন।

বিশ্ব ফুটবলে চার বছরের জন্য শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপার অধিকারী হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই টুইটার, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় নীতিতে দ্বিচারিতার সমালোচনা ঝড় উঠেছে। অভিবাসীরা এবং মুসলমান তারকারা যে ভূমিকা রেখেছেন, তার আলোকে দেশটির প্রতি অভিবাসননীতি সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে। এঁদের মধ্যে কেউ লিখেছেন, ‘অভিবাসীরা ফ্রান্সকে শক্তিশালী করেছে’, ‘আফ্রিকান এবং মুসলমানরা তোমাকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছে, তুমি এখন তাদেরকে ন্যায়বিচার দাও’ ইত্যাদি।

প্রশ্ন হচ্ছে, অভিবাসীদের প্রতি বিদ্বেষ বা বৈষম্যের প্রশ্নটি ইউরোপজুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে, এই বিশ্বকাপে অভিবাসীপ্রধান ফরাসি দলের বিজয় সেই বিতর্কে কি কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে?

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক প্রকাশনায় ৪ জুলাই বলা হয়, এবারে যাঁরা বিশ্বকাপ দেখছেন, তাঁরা সম্ভবত অভিবাসীদেরকেই দেখছেন (ফলোয়িং দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ: দেন ইউ আর ওয়াচিং হাই পারফরমিং মাইগ্রেন্টস অ্যাট ওয়ার্ক)। তাদের হিসাবে এবারের বিশ্বকাপে মোট ৩২টি দলের মোট ১ হাজার ৩২ জন খেলোয়াড় অংশ নিয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৯৮ জনের জন্ম অন্য কোনো দেশে, যা শতকরা হিসাবে প্রায় ১০-এর কাছাকাছি। এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোতেও ছিলেন অভিবাসী ফুটবলার। মরক্কো দলে অভিবাসীর হার ছিল ৬১ শতাংশ এবং সেনেগালে ৩৯ শতাংশ। সেমিফাইনালে আসা চারটি দলের মধ্যে একমাত্র ক্রোয়েশিয়া ছাড়া বাকি তিনটিতেই (ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও বেলজিয়াম) অভিবাসী ফুটবলারদের প্রাধান্য ছিল চোখে পড়ার মতো।

অভিবাসীরা কী ধরনের বিদ্বেষের মুখে পড়েন, তার একটা দৃষ্টান্ত দিয়েছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ওই নিবন্ধ। সুইডেনের মধ্যমাঠের খেলোয়াড় জিমি দারমাজ সিরীয় বংশোদ্ভূত। জার্মান দল তাঁর কারণে একটি ফ্রি কিক পেয়ে গেলে সুইডেন হেরে যায়। এরপর গালি হিসেবে তালেবান, সন্ত্রাসী ইত্যাদি ডাকার পাশাপাশি তাঁকে নানা ধরনের হুমকিও দেওয়া হয়। পরে সুইডিশ ফুটবল ফেডারেশন পুলিশের শরণাপন্ন হয়।

বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর যখন চলছিল, তখনই জুনের শেষ সপ্তাহে ইউরোপের নেতারা এক শীর্ষ বৈঠকে বসেছিলেন ব্রাসেলসে। তাঁদের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে অভিবাসন এবং তাঁরা আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হয়েছেন। ভূমধ্যসাগরে বিপন্ন অভিবাসনকামীদের উদ্ধারকারী স্বেচ্ছাসেবীদের নৌযানগুলোকে ইউরোপের দেশগুলো তাদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না। এতে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ বলছে, জীবন রক্ষাকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিতে হবে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তুবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, সাগরে উদ্ধারকারী জাহাজগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার যেকোনো হুমকির মানেই হচ্ছে উদ্ধারের মূলনীতিকেই আক্রমণ করা। আপনি তখন হয়তো দেখবেন যে জাহাজগুলো বিপদ থেকে উদ্ধারের বার্তা পাওয়ার পরও সাড়া দিচ্ছে না, যা শুধু অভিবাসী ও উদ্বাস্তুদের জন্য কঠিন পরিস্থিতি তৈরি করবে তা নয়, সাগরের বুকে বিপদে পড়া অন্য সবার জন্যই তা ঝুঁকি তৈরি করবে।

অবশ্য, এর পাশাপাশি ভালো খবরও আছে। এই প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অভিবাসনব্যবস্থার উন্নত ব্যবস্থাপনা, অভিবাসীদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়গুলোর সমন্বয় করে একটি বৈশ্বিক নীতিমালার প্রশ্নে সমঝোতায় পৌঁছেছে। ১৩ জুলাই সাধারণ পরিষদে এই সমঝোতা হয়, যা আগামী ডিসেম্বরে অভিবাসনবিষয়ক সম্মেলনে অনুমোদিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন নিয়মমাফিক অভিবাসনের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেবে এবং একই সঙ্গে তা কোটি কোটি অভিবাসীর অবৈধ পথে দেশান্তরি হওয়ার ঝুঁকি কমাবে।

বিশ্বে এখন অভিবাসীর সংখ্যা ২৫ কোটিরও বেশি এবং তাঁরা বিশ্ব জনসংখ্যার ৩ শতাংশ। তবে বৈশ্বিক মোট উৎপাদনের (গ্লোবাল জিডিপি) ১০ শতাংশ হচ্ছে তাঁদের অবদান। এই তথ্য জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের। তিনি গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাংবাদিকদের কাছে এসব পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেছেন, ‘অভিবাসীরা প্রবৃদ্ধির একটি চমৎকার চালিকা শক্তি। বিশ্বকাপের আসর মাতিয়েছেন যেসব অভিবাসী ফুটবলার, অর্থনীতিতে তাঁদের অবদান কতটুকু, সেই হিসাব পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’

ইউরোপের ফুটবলের একটা বড় অংশজুড়ে অভিবাসীরা। বিশ্বের সব প্রান্ত থেকে সবচেয়ে দক্ষ এবং যোগ্য খেলোয়াড়দের দলে টানতে ইউরোপের ক্লাবগুলো প্রতিবছরই একধরনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ইউরোপের ক্লাব ফুটবলে এমন কোনো প্রতিযোগিতা নেই, যেখানে অভিবাসী ফুটবলার নেই। ইউরোপে ফুটবলের অর্থও আসে এসব ক্লাবের নানা টুর্নামেন্ট থেকে। ফুটবলের বাণিজ্যিকীকরণে অভিবাসী ফুটবলারদের মেধা ও দক্ষতা হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অভিবাসীদের এসব অর্জনকে ইউরোপ নিজেদের সাফল্য হিসেবে তুলে ধরতে যতটা উৎসাহী, ঠিক ততটাই সংকীর্ণ অভিবাসীদের প্রতি তাদের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। ফ্রান্সের এই বিশ্বকাপ বিজয় থেকে সেই ধারায় পরিবর্তনের সূচনা হলে সেটিই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক ।