চাকরির অনিশ্চয়তাই যখন বেশি নিশ্চিত

কর্মসংস্থানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ হতে পারে অন্যতম বিকল্প। ফাইল ফটো: প্রথম আলো
কর্মসংস্থানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণ হতে পারে অন্যতম বিকল্প। ফাইল ফটো: প্রথম আলো

বাংলাদেশের জন্মের কারণ ছিল বৈষম্য। আমরা ধনে-জনে অধিক ফলনশীল হলেও প্রাপ্তির খাতায় তীব্রভাবে বৈষম্যের শিকার। সেদিনের অপ্রাপ্তিটা ছিল—‘আমার হাড় কালা করলাম রে, দেহ কালার লাইগা রে’ গানটার প্রতিধ্বনি। আজ স্বজাতির কাছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি কিনা এভাবেই হওয়ার ছিল! কিন্তু বৈষম্যের সংকট শুধু কোটাব্যবস্থাতেই না, আরও আগে থেকেই সেঁটে আছে আমাদের আপামর অস্থি, মজ্জায়, কোষে।

একটা সময় ছিল যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতেন না, তাঁরা ডিগ্রি কলেজ থেকে পাস কোর্সে পড়াশোনা করতেন এবং একইভাবে সব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতেন। অনেকে বুয়েটে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও আগেভাগেই বিসিএসে অংশ নিতে ডিগ্রি পরীক্ষায় বসতেন। আজ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে অনেক বেশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অনার্স পাস শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে উপযুক্তসংখ্যক চিকিৎসক, প্রকৌশলী তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এতে শিক্ষার এবং শিক্ষার্থীর যোগ্যতা এবং তাঁদের দেওয়া সেবার মানে কতটা যোগ হচ্ছে; বিয়োগ কিন্তু বিশাল!

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ জোগাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে হাঁসফাঁস করতে হয়। মাসে মাসে টানতে হয় সেমিস্টারপ্রতি বিশাল অঙ্কের ক্রেডিট ফি। তারপর কবে ডিগ্রি হবে, পাসের সার্টিফিকেট চাকরির বাজারে কতটা দাম পাবে, তাও দুশ্চিন্তার বিষয়। তাই কোটার কাছে প্রতারিত হওয়ার বহু আগেই প্রতারিত হতে হচ্ছে শিক্ষার বাণিজ্যিকায়নের কাছে। আর বেকারত্বের লম্বা সারি কেবল সরকারি কর্মকমিশনের দিকেই যায় না, বেসরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত করপোরেটে চাকরির বাজার বহুগুণ বৃহত্তর। কিন্তু সম্প্রতি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে বেকারত্ব বাড়ছে আরও বেশি হারে। ফলে স্নাতকদের ৪৩ শতাংশ বেকার।

অন্যদিকে, ছোট-বড় সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানেই শোনা যায় উপযুক্ত লোক পাওয়া যায় না। গুরুত্বপূর্ণ পদ খালি পড়ে আছে, কিন্তু কর্মকর্তারা সাক্ষাৎকার নিয়ে নিয়ে হতাশ। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডিগ্রি দিচ্ছে, কর্মী তৈরি করছে না। দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। চাকরিদাতারাও প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলে বসেনি, তাদের চাই তৈরি কর্মী। কাজে যোগদানের পর প্রশিক্ষণরত একজন কর্মী কোম্পানির খরচ খাত ছাড়া কিছুই নয়। অন্যদিকে, সেই কর্মী প্রশিক্ষণকালীন ‘কস্ট টু দ্য কোম্পানি’ কবে রিটার্ন দেবেন বা কোম্পানি ছেড়ে চলে যাবেন না, তারও নিশ্চয়তা নেই।

প্রসঙ্গক্রমে ভারতের তামিলনাড়ুর অরবিন্দ চক্ষু হাসপাতালের উদাহরণ দিতে চাই। কোনো রকম সরকারি-বেসরকারি অনুদান ছাড়া প্রধানত অসহায়দের বিনা মূল্যে বা অতি সুলভ মূল্যে সর্বাধিক চক্ষুসেবা দিয়ে যাচ্ছে এই হাসপাতাল। অস্ত্রোপচারের আগের ও পরের (প্রি এবং পোস্ট অপারেটিভ) কাজগুলো করেন এদের বিশেষায়িত নার্স ও স্টাফরা। এই বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্সদের স্রেফ হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আশপাশের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে বাছাই করা হয়। ১৭ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা দুই বছরের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে যোগদান করেন। এভাবে হাসপাতালের কাজের জন্য উপযুক্ত ও স্থায়ী কর্মী মিলে যায়, অন্যদিকে এসব দরিদ্র পরিবারকে উচ্চশিক্ষার জন্য লক্ষ্যবিহীন খরচও করতে হয় না। আখেরে হাসপাতালের সব সেবা খুবই সুলভ করাও সম্ভব হয়। আমাদেরও অগণিত অদক্ষ স্নাতকের বদলে প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী। তার জন্য চাই খাতওয়ারি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। এতে নিম্নবিত্ত শ্রেণির সন্তানদের স্নাতক বানাতে সর্বস্ব বাজি রেখে পরিশেষে নির্মম কোটাব্যবস্থার বা কর্মহীনতার ফাঁদে পড়তে হয় না। আমাদের দেশে এ ধরনের উপযোগী উদ্যোগ ও গবেষণা কম। হাতে গোনা কয়েকটি সংস্থাই কেবল প্রশিক্ষণ দিয়ে শূন্য থেকে কর্মী তৈরি করে থাকে।

আমাদের দেশে অবস্থাপন্ন পরিবারও অন্য আয়ের উপায় থাকার পরও খুবই কম বেতনের চাকরির জন্য লাখ টাকা ব্যয় করে। কারণ, বর্তমান অবস্থায় নিশ্চয়তা নেই, স্থায়িত্ব নেই, মর্যাদা নেই! বংশে কারও একবার সরকারি চাকরি জুটে গেলেই হলো। পরিচিত এক কম্পিউটার বিজ্ঞানের স্নাতক অনলাইনে কাপড়ের ব্যবসা করে বছরে কোটির অঙ্কে টার্ন ওভার নিশ্চিত করছেন। নিজে লোক রিক্রুট করেছেন। তবু সংসার, সন্তান আর সর্বোপরি নিজেকে বিধ্বস্ত করে নয়টা-পাঁচটা চাকরি করে যাচ্ছেন। হয়তো ভাবেন, কম্পিউটার প্রকৌশলী হয়ে অনলাইনে ব্যবসা করে জানলে লোকে কী বলবে! এ তো অর্ধশিক্ষিত যে-কেউও করতে পারে! অত্যন্ত সফল ‘টেন মিনিট স্কুল’-এর আয়মান সাদিকের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলাম, তিনি বাসায় রাত জেগে ভিডিও বানান শুনে পাড়া-প্রতিবেশীরা তাদের সন্তানকে সাদিকের ধারেকাছেও যেতে মানা করত। সমাজ ও পরিবারের এসব বাধা ডিঙিয়ে লেগে থেকে তাঁর মতো সফল হবেন, এমন কজন আছেন? সাধারণ গৃহস্থঘরের ছেলে পড়ালেখা করে যদি ভাবে, সামনের মজা পুকুরটা সাফ করে মাছ চাষ করবেন, বাবা ভাবেন, এত পড়ালেখা করে শেষতক ছেলে জাউলা হবে? তাই হাজার টাকার মাসমাইনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরির জন্যও উচ্চশিক্ষিতরা ছোটেন। কারণ, শিক্ষক তকমা লাগলে, বিশেষ করে নারীদের জন্য, পারিবারিক স্বীকৃতি ও সম্মান দুটোই সুলভ।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত চলেন মধ্যপন্থায়। তাই এখনো যেকোনোভাবে সরকারি চাকরিই কাম্য। যে দেশে অনিশ্চয়তাই বেশি নিশ্চিত, সেখানে সরকারি চাকুরে সবাই হতে চাইবে। এই গৎবাঁধা মনস্তত্ত্ব ভাঙতে কর্মী ও প্রশাসনসহ আমাদের প্রত্যেককেই অবদান রাখতে হবে।

উন্নত দেশের মতো ছাত্রজীবনেই কর্মসংস্থানের অভিজ্ঞতা অর্জন করা জরুরি। বিভিন্ন জব পোর্টালে এখন দেখতেও পাই খণ্ডকালীন, বিশেষ করে ছাত্রদের লক্ষ্য করেই অনেক চাকরির বিজ্ঞপ্তি। কলসেন্টার আরও আগে থেকেই আছে। কিন্তু নিজের পরিবার এবং আশপাশ দেখেই বুঝি এসব পেশা ‘আমাদের’ সন্তানদের জন্য নয়। তাদের জন্য একমাত্র শিক্ষাকালীন পেশা—গৃহশিক্ষকতা। অথচ এই বাচ্চাগুলোই যখন বিদেশে পড়তে যায়, তখন হেন কাজ নেই তারা করে না। করতে তাদের বাধেও না। কিন্তু দেশে এসব করা যায় না কেন? কারণ, সব পেশার প্রতি সম্মানবোধ এবং পেশাগত নিরাপত্তার অভাব। এই সামাজিক ‘ট্যাবু’ না কাটলে গণতান্ত্রিক ও বহুমুখী কর্মসংস্থান ঘটবে না। কোটা সংস্কার করা দরকার, কিন্তু শিক্ষাকে কর্মমুখী না করলে, কর্মের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে এবং সব কাজকেই সম্মান করতে না শিখলে কর্মসংস্থানের বাজারের নৈরাজ্য চলতেই থাকবে।

তানজিনা ইয়াসমিন চৌধুরী: জাপানপ্রবাসী গবেষক।