ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছে জামায়াত

সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সাতজন। আওয়ামী লীগের বদরউদ্দিন আহমদ কামরান, বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী, সিপিবি-বাসদের আবু জাফর, ইসলামী আন্দোলনের মোয়াজ্জেম হোসেন খান, বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী বদরুজ্জামান সেলিম, স্বতন্ত্র প্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়ের ও এহসানুল হক তাহের। দুই স্বতন্ত্র প্রার্থীর মধ্যে এহসানুল হক তাহের কোনো দলের নন এবং নিজেকে তরুণসমাজের প্রতিনিধি বলে দাবি করেন। অপরজন এহসানুল মাহবুব জুবায়ের নগর জামায়াতের আমির। আইনি বাধ্যবাধকতার কারণে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে তাঁর প্রার্থিতা নিয়ে অনেক বেশি কৌতূহল। নয় বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপি-জামায়াতকে ‘দুজনে দুজনার’ বলে উপহাস করে আসছে এবং এখনো করছে। অন্য প্রায় সব নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াত অভিন্ন নির্বাচনী কৌশল নিয়ে থাকে এবং একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। কিন্তু এবার সিলেটে ব্যতিক্রম দেখলাম। কেন্দ্রীয়ভাবে ২০-দলীয় জোটের বৈঠকে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দাবি জানালেও কাজ হয়নি। সিলেটে জামায়াত ভিন্ন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। স্থানীয় সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতে, এখানে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর সঙ্গে জামায়াত নেতাদের দ্বন্দ্ব বেশ পুরোনো। এই দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয় যখন মেয়র থাকাকালে আরিফুল হক জামায়াতের মালিকানাধীন উইমেন্স মেডিকেল কলেজের সীমানা দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন সড়ক সম্প্রসারণ করার জন্য। জামায়াতের নেতারা এটিকে ভালোভাবে নেননি।

স্থানীয় বিএনপি নেতারা মনে করেন, সারা দেশে জামায়াত বিএনপির সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চললেও সিলেটে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই তাদের বোঝাপড়া বেশি। এমনকি নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী জামায়াতের সমর্থকদের বেশি ভোট পান। এ ছাড়া দলটি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সিলেটের জামায়াতের নেতাদের মালিকানাধীন অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল-ক্লিনিকে আওয়ামী লীগের লোককে ‘উপদেষ্টা’ হিসেবে নিয়েছে। এ নজির শুধু সিলেটে নয়, সারা দেশেই কমবেশি আছে।

এ অবস্থায় সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর নেতা নিজেকে মেয়র পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে স্থানীয় বিএনপির পক্ষ থেকে তা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো চাপ বা অনুরোধ আসেনি। বরং আলোচনা প্রসঙ্গে বিএনপির একাধিক নেতা বলেছেন, আওয়ামী লীগ আমাদের জামায়াতের দোসর, যুদ্ধাপরাধীদের সহযোগী বলে গালমন্দ করে। এখন সিলেটে স্পষ্ট হয়ে যাক কে কার সহযোগী। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জামায়াতে ইসলামী এগোচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলটি স্বনামে নির্বাচন করতে পারবে না ঠিক, কিন্তু বেনামে নেতাদের অংশ নিতে বাধা নেই। জাতীয় নির্বাচনে তারা যে নিজেদের শক্তি পরীক্ষায় নামতে চায়—তার মহড়াটি সিলেট থেকে শুরু করতে চাইছে মৌলবাদী ধ্যানধারণা পুষ্ট দলটি।

জামায়াতের রাজনৈতিক সংহতির আরেকটি উদাহরণ পাওয়া যায় কাউন্সিলর পদে প্রার্থী মনোনয়নে বা সমর্থনে। সিলেটে ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি খুব কম ওয়ার্ডেই একক প্রার্থী দিতে পেরেছে। বেশির ভাগ ওয়ার্ডে দুই দলেরই একাধিক প্রার্থী আছেন। নেতারাও এ নিয়ে বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না। কেননা, দল কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করলে তাঁর প্রতিপক্ষ ক্ষুব্ধ হবে, যার প্রভাব পড়তে পারে মেয়র নির্বাচনে। এ কারণে দুই দলই ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদটি উন্মুক্ত রেখেছে অথবা রাখতে বাধ্য হয়েছে। আইন অনুযায়ী সিটি নির্বাচন আধা দলীয়, আধা নির্দলীয়। মেয়ররা দলীয়, কাউন্সিলররা নির্দলীয়। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ এর নাম দিয়েছেন ‘দো-আঁশলা।’

বিএনপি ও আওয়ামী লীগের স্ববিরোধী নীতি ও অবস্থানের বিপরীতে জামায়াতে ইসলামী ১৩টি ওয়ার্ডে একক প্রার্থী দিয়েছে। কতটি ওয়ার্ডে দল জয়ী হবে কিংবা মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী কত ভোট পাবেন, সেই বিবেচনার চেয়েও তাদের কাছে অগ্রাধিকার পেয়েছে নির্বাচনী মাঠে সরব থাকা, প্রার্থিতার সুযোগে দলের নীতি ও আদর্শের কথা ভোটারদের কাছে পৌঁছানো। আওয়ামী লীগ মনে করছে, বিএনপি থেকে জামায়াতকে দূরে রাখতে পারলে তারা লাভবান হবে। আবার সিলেট বিএনপির নেতাদের হিসাব হলো, ওরা আলাদা নির্বাচন করায় এখন আর কেউ তাদের জামায়াতের দোসর বলতে পারবে না। বিএনপির উদারপন্থী নেতারা চান জাতীয়ভাবেও এ সমীকরণ তৈরি হোক।

সাম্প্রতিক নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা ‘ভালো ভোট’ পেয়েছেন। খুলনা ও গাজীপুরে দলীয় প্রার্থীর অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরই। অনেক বিশ্লেষকের মতে, জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে সমদূরত্বে থাকা দলটি আগামী নির্বাচনে নতুন ইসলামি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। গরিব শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেই এর সমর্থন বেশি। জিন্দাবাজার এলাকায় এক মধ্যবয়সী রিকশাচালককে দেখলাম ইসলামী আন্দোলনের প্রতীক ‘হাতপাখা’ লাগিয়ে রেখেছেন রিকশার সামনেই। তিনি যাত্রী বহনের পাশাপাশি দলের পক্ষে ভোটের প্রচার করছেন। অর্থাৎ জামায়াত ধনীদের ইসলামি দল হলে ইসলামী আন্দোলন গরিবদের ইসলামি দল। তবে নীতি ও আদর্শে দুটিই পশ্চাৎমুখী।

বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বললেন, সিলেটের বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। বরং দলটি বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। মেয়র প্রার্থী আরিফুল হকও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, জামায়াতে ইসলামী প্রার্থী দিয়েছে, এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা নেই। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা পরীক্ষা হয়ে যাক কার কেমন ভোট আছে।

জামায়াতে ইসলামী শুধু সিলেটের কথা চিন্তা করে মেয়র পদে প্রার্থী দিয়েছে, তা নয়। তারা সিলেট নির্বাচনকে নিয়েছে ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে। এখানে সফল হলে অন্যান্য স্থানেও একই কৌশল ব্যবহার করবে। তবে জাতীয়ভাবে এ সমীকরণ কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিএনপির নেতারা মনে করেন, আজ তাঁরা জামায়াতে ইসলামীকে ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগ কোলে তুলে নেবে। যেমনটি নিয়েছে সাবেক স্বৈরাচারকে। তাই তাঁরা মিত্রকে শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দিতে চাইছেন না। কিন্তু জামায়াতের নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা আছে। দলীয় রাজনীতিতে আশু লাভের চেয়ে তারা দীর্ঘমেয়াদি লাভের কথাই ভাবে।

এই মুহূর্তে রাজনীতির চেয়েও সারা দেশে জামায়াত নেতাদের মালিকানাধীন যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলো রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করেন জামায়াতের নেতারা। এ কারণে জাতীয়ভাবে সম্ভব না হলেও স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সদ্ভাব রেখে চলার নীতিও নিয়েছে দলটি।

উল্লেখ্য, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যেমনটি প্রচার করে থাকে, বিএনপি জামায়াতের ‘চিরসখা’ নয়। ১৯৮৬ সালে এরশাদের অধীনে যে নির্বাচন হয়, তাতে অন্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামী অংশ নেয়। যদিও বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করেছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালেও যুদ্ধাপরাধীদের দলটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করেছিল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে। অতএব, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]