কোটা সংস্কারে আইনের বাধার কথা কেন?

কোটা সংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধা কোটা প্রসঙ্গ। কোটা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় সবচেয়ে বেশি আপত্তিও এসেছে এই কোটা নিয়ে। এই আপত্তির প্রথম কারণ, এখানে কোটার হার সবচেয়ে অসমানুপাতিক। মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের সন্তানসহ মোট জনসংখ্যা যেখানে ১ শতাংশের মতো বা এরও কম, সেখানে তাঁদের জন্য রাখা হয়েছে ৩০ শতাংশ কোটা। দুই. একমাত্র এটিই দুর্নীতিবান্ধব একটি কোটা। কারও পক্ষে ভুয়া নারী বা ভুয়া প্রতিবন্ধী হওয়ার সুযোগ নেই, কিন্তু ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে এখানে ব্যাপক দুর্নীতি সম্ভব। তিন. ঢালাওভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা প্রদানের সাংবিধানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নকালে গণপরিষদ বিতর্কে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাটি আলোচিত হয়েছিল সামাজিক নিরাপত্তা দেওয়া প্রসঙ্গে (অনুচ্ছেদ ১৫), চাকরিতে কোটা (অনুচ্ছেদ ২৮/২৯) দেওয়া প্রসঙ্গে নয়।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে মুক্তিযোদ্ধা কোটার কোনো সংস্কার হবে না। এর কারণ হিসেবে তিনি উচ্চ আদালতের একটি রায়ের কথা বলেছেন। বলেছেন, এই রায়ের কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার হলে তা আদালত অবমাননা হবে।

এই বক্তব্য অবশ্য প্রথম আসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে। ১১ জুলাইয়ের এই প্রেসনোটে স্পষ্টভাবে উচ্চ আদালতের দুটো রায়ের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এসব রায়ের কারণে মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার করা যাবে না। কিন্তু এসব রায়ের ব্যাখ্যা করলে দেখা যাবে, এসব রায় আসলে কোটা সংস্কার প্রসঙ্গে নয়; বরং কোটা বাস্তবায়ন-সম্পর্কিত। কাজেই কোটা সংস্কার হলে কোনোভাবেই তা আদালত অবমাননা হওয়ার কথা নয়।

২.
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে যে দুটো রায়ের কথা বলা হয় তা হচ্ছে: (ক) হাইকোর্টের ২০১২ সালের রিট পিটিশন নম্বর ২৩৫, (খ) আপিল ডিভিশনের ২০১৩ সালের সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নম্বর ২০৬২। এ ছাড়া উচ্চ আদালতে মুক্তিযোদ্ধাদের সুবিধা ও মর্যাদা প্রশ্নে আরও কয়েকটি রায় হয়েছে এ পর্যন্ত। কিন্তু আলোচনার বিষয়ের দিকে লক্ষ রেখে আমরা শুধু উপরিউক্ত দুটো রায় নিয়েই এখানে আলোচনা করব।

প্রথমেই বলে রাখি, হাইকোর্টের ২০১২ সালের রিট পিটিশন নম্বর ২৩৫ মামলায় ‘কোটা সংস্কার’ কোনো বিচার্য বিষয় ছিল না, এমনকি আদালত এ নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণও প্রদান করেননি। প্রথমে আসি বিচার্য বিষয় সম্পর্কে। এই মামলায় বিচার্য বিষয় ছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স নির্ধারণ নিয়ে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে তাঁদের অবদান ও ত্যাগের কথা বিবেচনা করে ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরে ২০১১ সালের পাবলিক সার্ভেন্টস রিটায়ারমেন্ট অ্যামেন্ডমেন্ট অরডিন্যান্সের মাধ্যমে সব সরকারি চাকরিজীবীর অবসরের বয়স ৫৭ থেকে ৫৯-এ উন্নীত করা হয়েছিল।

পিটিশনার জামালউদ্দিন শিকদার এই মামলায় অভিযোগ করেন, এই অরডিন্যান্সের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের অবসরের বয়স মুক্তিযোদ্ধাদের অনুরূপ করার কারণে ২০১০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া সুবিধাটি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে এবং এর মাধ্যমে তাঁরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।

আদালতে সরকারপক্ষ অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স এক বছর বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলে আদালত সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে এটি করার নির্দেশ দেন এবং তা ২০১০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ভূতাপেক্ষভাবে প্রয়োগের নির্দেশ দেন (উল্লেখ্য, এই আদেশ এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি)।

আদালত এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে আরও কিছু নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ প্রদান করেন। এর মধ্যে একটি পর্যবেক্ষণ ছিল উপযুক্ত মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী না পাওয়া গেলে কোটার পদগুলো শূন্য রাখা হবে কি না, তা নিয়ে। পর্যবেক্ষণটির অনুবাদ এ রকম:

‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত ৩০ শতাংশ কোটা পুরোপুরিভাবে (স্ট্রিকটলি) অনুসরণ করা হবে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান দ্বারা পূরণ করার সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে এবং যদি কোটা পূরণ করতে না পারা যায়, তাহলে ২০১০ সালের রিট পিটিশন নম্বর ৬৪০-এ এই আদালত নির্দেশ মোতাবেক সংশ্লিষ্ট পদগুলো শূন্য রাখতে হবে।’

হাইকোর্টের এই রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে সরকারপক্ষ আপিলের অনুমতি প্রার্থনা করে। এতে আপিল ডিভিশন (২০১৩ সালের সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নম্বর ২০৬২) অন্য কিছু বিষয়ের সঙ্গে হাইকোর্টের উপরিউক্ত পর্যবেক্ষণটি সংশোধন করে দেয়। সেই মোতাবেক মুক্তিযোদ্ধা কোটায় উপযুক্ত প্রার্থী না থাকলে শূন্য পদগুলো মেধাবীদের দিয়ে পূরণ করা যাবে।

এই রায়গুলোর কোনোটিতেই কোটা সংস্কার বা এটি বাড়ানো, কমানো, বিলোপ করা—এগুলো বিচার্য বিষয় বা পর্যবেক্ষণের বিষয় ছিল না। আদালত শুধু সরকারের একটি নীতি (মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা) কীভাবে বাস্তবায়িত হবে (শূন্য রেখে, নাকি অন্যদের দিয়ে পূরণ করে), সে সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছেন।

৩.
ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতি অনুসারে, আদালত কোনো আইন বা সরকারি নীতি তৈরি করে দিতে পারেন না, তা সংশোধনও করতে পারেন না। আদালত শুধু কোনো আইন বা নীতির ব্যাখ্যা দিতে পারেন, এটি সংবিধানবিরোধী হলে বাতিল করতে পারেন বা ক্ষেত্রবিশেষে আইন বা নীতি প্রণয়নের কোনো গাইডলাইন দিতে পারেন।

মুক্তিযোদ্ধা হোক, নারী বা আদিবাসী হোক, কাদের জন্য সরকারি চাকরিতে কতটুকু কোটা থাকবে, এটি আদালতের কর্তৃত্বাধীন বিষয় হতে পারে না। সরকার কোনো কোটা বিলোপ করলে আদালত হয়তো বলতে পারেন যে এটি সংবিধানসম্মত নয়, কিন্তু সরকার কোটা সংস্কার করতে চাইলে আদালত বলতে পারেন না যে এটি করা যাবে না।

হাইকোর্টে কোটা সংস্কারের আরজি জানিয়ে একটি পিটিশন হয়েছিল এ বছরের ৩১ জানুয়ারি। সেখানে আদালত বরং স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছিলেন, কোটা সংস্কারের একমাত্র এখতিয়ার সরকারের (ইত্তেফাক, ৫ মার্চ, ২০১৮)।

আরেকটি কথা, উচ্চ আদালতের রায় দুটো অনুসারে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতির জন্য চাকরিতে কোটা রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, এখানে ‘চিলড্রেন’ শব্দটি ব্যবহার করে এই সুবিধা শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য রাখা হবে—এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে তা কত শতাংশ রাখা হবে, সেটি নতুন করে নির্ধারণ করার এখতিয়ার সরকারের রয়েছে।

কোটা সংস্কারে আইনগত বাধা তাই নেই বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

আসিফ নজরুল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক