রাহুলের ঝাপ্পি ও রাফায়েলের গুঁতো

মোদি সরকারকে তুলাধোনা করে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রাখেন রাহুল
মোদি সরকারকে তুলাধোনা করে লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রাখেন রাহুল

নরেন্দ্র মোদিকে দেওয়া রাহুল গান্ধীর ‘পেয়ার কি ঝাপ্পি’, নাকি অনাস্থা প্রস্তাবকে হেলায় হারিয়ে মোদি সরকারের জয়, কোনটা বেশি চমকপ্রদ, এ মুহূর্তে ভারতজুড়ে চলছে তার চর্চা। এক ঘণ্টা ধরে মোদি সরকারকে তুলাধোনা করে ভরা লোকসভায় প্রধানমন্ত্রীর গলা জড়িয়ে বুকে মাথা রেখে রাহুল যে রাজনৈতিক বার্তা ছড়িয়ে দিতে চাইলেন, কংগ্রেস সভাপতির ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হলো, নাকি নিজেই নিজেকে ‘জোকার’ করে তুললেন, চায়ের কাপে তা তুফান তুলেছে। পরিহাসের বিষয় এটাই, গণতন্ত্রে প্রায়ই মূল প্রশ্ন ছাপিয়ে নাটক ও নাটকীয়তা জায়গা দখল করে। সে কারণে অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে বিতর্কে কংগ্রেস সভাপতি প্রধানত যে প্রশ্নগুলোর উত্তর প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পেতে চেয়েছিলেন, নাটকীয়তার দৌলতে প্রধানমন্ত্রী তা ছাইচাপা দিলেন।

ফলে ফ্রান্সের কাছ থেকে তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে অনেক কম রাফায়েল যুদ্ধবিমান ভারত কেন কিনছে ও কোন যুক্তিতে, তা জানা গেল না। এই কেনাবেচা ভারতের এক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সর্বনাশ করে ব্যক্তিমালিকানার এক সংস্থাকে পৌষ মাসের সুখ, আমেজ ও তৃপ্তি কেন পাইয়ে দিল, জানা গেল না   তা-ও। এই সরকার যত দিন ক্ষমতায় আসীন, তত দিন তা জানা যাবে কি না, সন্দেহ থাকল তা নিয়েও। কেননা, অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলাকালে ফ্রান্স ও ভারত দুই দেশই প্রায় একযোগে চুক্তির গোপনীয়তার বিষয়টি নতুনভাবে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে।

এতে রাহুল গান্ধীর তোলা প্রশ্নের উত্তর হয়তো অনুচ্চারিত থাকল, নরেন্দ্র মোদি হয়তো দুর্নীতির অভিযোগের বিড়ম্বনা থেকে নিজেকে আড়াল করলেন, কিন্তু সন্দেহ দূর হলো না। গণতন্ত্রে সন্দেহ বড় বিষম বস্তু। বোফর্স কেনাবেচা নিয়ে সন্দেহ ও প্রচার রাজীব গান্ধীকে ধরাশায়ী করেছিল। রাফায়েল নরেন্দ্র মোদিকে ঘায়েল করতে পারবে কি না, আগামী বছর ভোটের ফলে তা বোঝা যাবে।

রাফায়েল যুদ্ধবিমান কেনাবেচা নিয়ে কংগ্রেসের অভিযোগ আলোচনার আগে এই চুক্তি ও তার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার। ২০০০ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, মিগ-২১ ও ২৭ সিরিজের রুশ যুদ্ধবিমানগুলোর বয়স হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সেগুলো তুলে নেওয়া হবে। বদলে কেনা হবে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। ২০০২ সালে মোট ১২৬টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার জন্য টেন্ডার ডাকা হয়। ঠিক হয়, এই বিমানগুলোর মধ্যে ১৮টি কেনা হবে একেবারে তৈরি অবস্থায়, বাকি ১০৮টি বিমান প্রযুক্তি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হবে বেঙ্গালুরুর সরকারি সংস্থা হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেডের (হ্যাল) কারখানায়। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িং ও লকহিড মার্টিন, রাশিয়ার ইউনাইটেড এয়ারক্রাফট করপোৎোরশন, ফ্রান্সের ডাসল্ট, ইউরোপিয়ান অ্যারোনটিকস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস (ইএডিএস) ও সুইডেনের ‘সাব’ দরপত্র পাঠায়। সবচেয়ে কম দর হাঁকিয়েছিল ফ্রান্সের ডাসল্ট। তাই তাদের প্রাথমিকভাবে পছন্দ করা হয়। সেটা ২০১২ সাল। পরের বছর শুরু হয় আলোচনা, হ্যালে যে ১০৮টি বিমান তৈরি করা হবে, প্রধানত তা নিয়ে। এই আলোচনা চলতে চলতেই এসে যায় ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন।

ক্ষমতায় এসে নরেন্দ্র মোদি পুরোনো চুক্তি বাতিল করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর যুক্তি ছিল, রাফায়েল বিমান খুবই দামি। এত টাকা খরচ করে এতগুলো যুদ্ধবিমান কেনার কোনো দরকার নেই। শেষমেশ অবশ্য তিনি প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি মেনে নেন এবং ঠিক করেন, ১২৬টা নয়, ৩৬টা রাফায়েল কেনা হবে, যেগুলো পুরোপুরি তৈরি বা ‘রেডি টু ফ্লাই’।

কংগ্রেস আমলে যে চুক্তিটা সই হয়েছিল, তাতে ১২৬টা রাফায়েল বিমান, তার ক্ষেপণাস্ত্র, যন্ত্রাংশ এবং অন্যান্য প্রযুক্তি বাবদ খরচ হতো ৭৯ হাজার ২০০ কোটি রুপি। সেই চুক্তিতে বলা ছিল, ১৮টা ‘রেডি টু ফ্লাই’, বাকি ১০৮টা ডাসল্ট তৈরি করবে ‘হ্যাল’-এ। খরচের প্রশ্ন তুলে সেই চুক্তি বাতিল করে নরেন্দ্র মোদির সরকার নতুন যে চুক্তি করল, তাতে রাফায়েল আসবে ৩৬টা। ক্ষেপণাস্ত্র, যন্ত্রাংশ ও সব ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে খরচ পড়বে ৫৮ হাজার কোটি রুপি। কংগ্রেস হিসাব কষে দেখাচ্ছে, তাদের করা চুক্তিতে যেখানে বিমানপ্রতি খরচ হতো ৬২৯ কোটি, সেখানে মোদির করা চুক্তিতে বিমানপ্রতি খরচ পড়ছে ১ হাজার ৬১১ কোটি রুপি! রাহুলের দাবি, পুরোনো চুক্তি অনুযায়ী বিমান কিনলে ৩৬টার জন্য যেখানে সরকারকে দিতে হতো ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি রুপি, মোদি সরকার সেখানে দিচ্ছে আড়াই গুণ বেশি দাম! মোট ৫৮ হাজার কোটি রুপি! শুধু তা–ই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হ্যাল’কে বঞ্চিত করে নরেন্দ্র মোদি লাভবান করলেন এক বেসরকারি সংস্থাকে, প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত বিষয়ে যাদের অভিজ্ঞতা মাত্র কয়েক বছরের!

হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকস লিমিটেড বা ‘হ্যাল’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে। তুলনায় শিল্পপতি অনিল আম্বানির ‘রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড’ বা আরডিএলের জন্ম মাত্র দুই বছর আগে। মহারাষ্ট্রের নাগপুরে এদের কারখানা। কংগ্রেস যে চুক্তিটা করেছিল, তাতে ‘হ্যাল’ শুধু উপকৃতই হতো না, ডাসল্ট প্রযুক্তিও হস্তান্তর করত। নতুন চুক্তিতে সেই বাধ্যবাধকতা ফ্রান্সের কোম্পানির রইল না। তারা আরডিএলের সঙ্গে আলাদা একটা চুক্তি করে। তাতে ঠিক হয়, রাফায়েল বাবদ যে ৫৮ হাজার কোটি রুপি (৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো) তারা পাবে, তার ৩০ শতাংশ তারা যুদ্ধবিমান–সংক্রান্ত গবেষণায় খরচ করবে এবং ২০ শতাংশ খরচ করবে স্থানীয় স্তরে যন্ত্রাংশ তৈরিতে।

ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ফ্রান্স সফরে গিয়ে মোদি যখন ৩৬টা রাফায়েল কেনার কথা ঘোষণা করেন, তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর তখন তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন না। প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত কেবিনেট কমিটিও তখন পর্যন্ত ওই কেনাবেচার অনুমোদন দেয়নি। কিন্তু মোদির সঙ্গে সেই সফরে ফ্রান্স গিয়েছিলেন শিল্পপতি অনিল আম্বানি। পারিকরকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল সফরের কয়েক দিন আগে। তিনি বলেছিলেন, আগের চুক্তি অর্থনৈতিক দিক থেকে কার্যকর ছিল না। নতুন চুক্তিতে আর্থিক সাশ্রয় হবে। পারিকর তখন বলেছিলেন, নতুন চুক্তিতে প্রতিটি রাফায়েলের জন্য খরচ হবে ৭১৫ কোটি রুপি।

পারিকর যে হিসাব দিয়েছিলেন, তখনই তা ছিল কংগ্রেসের চুক্তির থেকে বেশি। আর এখন? মোদির ভারতকে গুনাগার দিতে হচ্ছে আড়াই গুণ!

গোপনীয়তার ধারার দরুন রাফায়েল চুক্তি নিয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব না দেওয়ার যুক্তিতে মোদি অটল। কিন্তু টাকার অঙ্ক কেন আড়াই গুণ বেশি, এত বেশি টাকা দিয়ে কেন মাত্র ৩৬টা যুদ্ধবিমান কেনা হচ্ছে, কেন সরকারি সংস্থাকে বঞ্চিত করে বন্ধু শিল্পপতির স্বার্থ দেখা হচ্ছে, এই প্রশ্নাবলির সঙ্গে দেশের প্রতিরক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। ভোটের দিন যত এগোবে, প্রশ্নগুলো ততই ফুলেফেঁপে উঠতে থাকবে। গোপনীয়তা এই কারণে, যাতে অন্য দেশ প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত রাফায়েলের খুঁটিনাটি জানতে না পারে। কিন্তু এ কথাও সবার জানা, ওই গোপনীয়তা আসলে বজ্র আঁটুনির ফসকা গেরোর মতোই। প্রতিরক্ষা নিয়ে যাঁদের কাজকারবার, তাঁদের কারও অজানা নয় কোন যুদ্ধবিমানের চরিত্র কী। আমাদেরও জানা, কংগ্রেস রাফায়েলের জন্য যে ক্ষেপণাস্ত্র আনতে চেয়েছিল, বিজেপি আনতে চলেছে তার চেয়ে উন্নত ‘মেটেওর’ ক্ষেপণাস্ত্র। তা ছাড়া অন্য একটি প্রশ্নও প্রাসঙ্গিক। গোপনীয়তার চুক্তি তো ১০ বছরের মেয়াদ পেরিয়ে গিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদিও তো বারবার ‘ট্রান্সপারেন্ট’ বা স্বচ্ছ প্রশাসনের বড়াই করেন। নতুন চুক্তিতে কেন তাহলে তিনিও গোপনীয়তাকে প্রশ্রয় দিলেন? তাহলে তিনিও কি চাইছেন গোপনীয়তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মারাত্মক কিছু গোপন করতে?

চার বছর আগে নরেন্দ্র মোদির সাদা কাগজে কোনো দাগ ছিল না। আজ সেখানে অনেক আঁকিবুঁকি। রাফায়েল সেই আঁকিবুঁকির একটা মোটা আঁচড়। বিজেপির মনে রাখা উচিত, ভারতীয় ভোটারদের মনে বোফর্সের স্মৃতি কিন্তু এখনো ফিকে হয়নি।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি