পুলিশের ভূমিকাই সিলেটের বড় ভয়

>সিটি নির্বাচন সামনে রেখে  সিলেটের নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ে লেখা হলো। সিলেট থেকে সরেজমিনে লিখেছেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান 

চায়ের দোকানটি জেল রোডের মোড়েই। চায়ের দোকানি এক তরুণ আর সেখানে মধ্যাহ্নের আলস্য উপভোগ করতে করতে দুধ চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন এক মধ্যবয়সী ছিন্নমূল নারী। দুজনেই আরও অনেকের মতো ৩০ তারিখে ভোট দিতে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। ভোটকেন্দ্রে না যেতে পারার মতো কোনো শঙ্কার কথা এ দুজনের কেউ বলেননি। কাছেই বেঞ্চিতে বসে ছিলেন আরেক যুবক। তিনি ভোটার নন। কিন্তু শহরের একজন দিনমজুর। কী জানতে চাই বুঝতে পেরে পরিষ্কার করলেন, ‘মানুষ তার ভোট দিতে পারবে না, সেই আশঙ্কা এখনো কেউ করে না। কিন্তু অন্য কিছু হলে আলাদা কথা।’ অন্য কিছু কী? জানতে চাইলে বলেন, ‘ওই যে কী সিস্টেম আছে না, সেটা হলে আলাদা।’

তবে ওই ‘সিস্টেম’ হবে কি হবে না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হলেও সিলেটের আন্তদলীয় সম্প্রীতি এবং সার্বিক নির্বাচনী পরিবেশ অপেক্ষাকৃত ভালো রয়েছে। গত সপ্তাহের ধরপাকড় না ঘটলে সিলেটের নির্বাচনী পরিবেশকে চমৎকার এবং অনুকরণীয় হিসেবে বর্ণনা করা যেত। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে কোনো উত্তেজনা বা মৃদু পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেনি। প্রচারণাকার্যে সহিংসতা বলতে যুবলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সহিংসতার যে খবর বেরিয়েছিল, তারও সত্যতা মেলেনি। জামায়াতের এক কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ মিছিলও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে। আসলে গত ১০ বছরে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক প্রশাসনিক মামলা অনেক হলেও ছাত্রলীগ বা সরকারি দল-সংশ্লিষ্ট সহিংসতা দু-চারটির বেশি নয়।

তবে গতকাল অপরাহ্ণে যখন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার পরিতোষ ঘোষের দপ্তরে তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ৩০ তারিখে কতটি কেন্দ্র আপনারা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন? তখন তিনি বললেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ বলি না, আমরা বলি গুরুত্বপূর্ণ। ১৩৪টির মধ্যে এ রকম ৮০টি।’ জানতে চাই, কিসের ভিত্তিতে আপনারা এটা ঠিক করলেন? তিনি বললেন, কাউন্সিলরদের মধ্যে বিরোধ কিংবা প্রার্থীর বাড়ি-সংলগ্ন ভোটকেন্দ্রগুলো নিয়ে শঙ্কা আছে। প্রতিটি কেন্দ্র পাহারায় ২৪ জন থাকবে।

সবকিছু মিলিয়ে মনে হলো প্রশাসন চাইলে সিলেট ভালো নির্বাচনের একটি উদাহরণ হতে পারে। আর এই নির্বাচনে দুই বড় দলের প্রার্থীর যে কারও মেয়র হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। গণনার আগ পর্যন্ত কেউ কাউকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ থাকার নয়। নৌকা ও ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এই প্রথম দুই প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচন করছেন। সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে আরিফুল হকের কিছু গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু ধানের শীষে সিল দিতে গিয়ে সংখ্যালঘুরা কতটা স্বস্তি পাবেন, সেই প্রশ্ন অগ্রাহ্য করার নয়।

সিলেট মহানগরী এখনো শিল্প ও কলকারখানা এবং অস্থানীয়দের (এক-চতুর্থাংশের কমবেশি) দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়নি। এটিই দেশের একমাত্র শহর, যেখানে প্রায় প্রতিটি ঘরের সঙ্গে অন্তত একজন করে লন্ডনি বা ইউরোপপ্রবাসী বাংলাদেশির যোগসূত্র রয়েছে।

আর সবকিছু ছাপিয়ে আছে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর ছড়িয়ে দেওয়া সুফিবাদী প্রভাব। মার্কিন ইতিহাসবিদ ইটনের বর্ণনা অনুযায়ী, মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা চীন থেকে ১৭ দিন উত্তাল নৌকা চালিয়ে যখন সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর সাক্ষাৎ পান, তখন তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষের মানবতাবাদী ত্রাতা হিসেবে তাঁকে দেখে মুগ্ধ হন। ইবনে বতুতা সিলেটে এসেছিলেন ৬৭৩ বছর আগে, ১৩৪৫ সালে। অনেকেই একমত যে এমন কিছুর ঐতিহ্যের মিশেলেই যুগ যুগ ধরে সিলেটে মৈত্রীর বন্ধন পাকাপোক্ত হয়েছে। মন্তব্য চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রশাসনের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নেতিবাচকতার মধ্যেও সমঝোতার দিকেই ইঙ্গিত করেন। তাঁর কথায়, বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিপণিবিতান পরিচালনায় নামে-বেনামে তাঁদের (আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত) অংশীদারত্ব আছে।

২৪ জুলাই বিকেলে শহরে পৌঁছার পর থেকে দুই মেয়র প্রার্থী, পুলিশ প্রশাসনসহ যেখানে যত আলোচনা করেছি, তাতে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যেকোনো দলের প্রার্থীই জয়ী হওয়ার অবস্থায় রয়েছেন। বিশাল ভোটের ব্যবধানে জয়-পরাজয়ের ঘটনা এখানে ঘটবে না। যাঁরা এই ধারণা পোষণ করেন যে ব্যক্তি নয়, কলাগাছ দাঁড়ালেও শুধু প্রতীকের জোরেই চূড়ান্ত বিজয় স্থির হবে, সিলেটের এবারের সিটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি তেমন হবে না। সিলেটের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা কিংবা খালেদা জিয়ার ওপর আস্থা ধরনের কোনো বিষয়-আশয় থেকে যোজন যোজন দূরে। দুজন ভিন্ন ভিন্ন এবং প্রায় সর্বতোভাবে স্থানীয় কারণে জয়ী বা পরাজিত হতে পারেন।

জনগণের কাছে দুই সাবেক মেয়রের বিরাট জনপ্রিয়তা রয়েছে। বিদায়ী মেয়র হিসেবে আরিফুল হকের কিছুটা ধূসর অতীত যেন একদম চাপা পড়ে গেছে ২৭ মাস জেলে থাকা এবং মুক্ত অবস্থায় মাত্র ২৪ মাসের কম সময়ে নগরীর ব্যাপক উন্নয়ন করা। এ জন্য অনেকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আরিফুলের সঙ্গে ভালো সম্পর্কের দিকে আঙুল তুললেও আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী সিলেটকে বিশেষ গুরুত্ব দেন বলেই সিলেট নগরীর উন্নয়ন নিশ্চিত করা গেছে। তবে সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের সদাচরণ এবং বিএনপি ও তার মিত্রদের ভোট ভাগ হওয়া তাঁকে সম্ভাবনাময় প্রতিযোগীতে পরিণত করেছে। কামরানই জানালেন, মানুষের সঙ্গে অসদাচরণ এবং উন্নয়নের নামে ভাঁওতা দেওয়ার মতো কথার বাইরে কিছু তিনি আরিফুল সম্পর্কে বলেন না। এমনকি শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডে আরিফুলের কথিত জড়িত থাকা বিষয়েও তিনি মন্তব্য করেন না। আর আরিফুল কামরানকে বলেছেন বড় ভাই। হাস্যোজ্জ্বল, রসিকতায় তাঁর তুলনা নেই। তবে সমালোচনা করেন এটুকুই, তাঁর ১৮ বছরের দায়িত্বে নগরবাসীর আশা পূরণ হয়নি। করমর্দন ও কোলাকুলি ‘কৃত্রিম’ হলেও তাঁরা সেটা সুযোগ এলেই করে থাকেন। জামায়াতের প্রার্থীও বাদ যান না।

আসলে ১৯ জুলাইয়ের আগে সিলেটের নির্বাচনী প্রচারণায় ‘শঙ্কা’ কথাটি যুক্ত করার উপায় ছিল না। সেই দিক থেকে পুলিশই বড় ভয়। কথিত সহিংসতা, মামলা ও আগাম জামিন, কোনোটিই এখনো বড় উদ্বেগজনক বিষয় নয়। পুলিশ স্পষ্টতই নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে, শান্তির জন্য যেন তারাই ভয়ের কারণ, এটা রোধ করা দরকার এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখালে তা সম্ভব। পুণ্যভূমি বিবেচনার প্রশ্নটি হালকা নয়, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা হজরত শাহজালাল (রহ.)–এর মাজার জিয়ারত দিয়েই শুরু হয়।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক