জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এক দূরের স্বপ্ন

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একসময় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগার থাকত, কিন্তু দেশে শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এ দুটি অঙ্গের প্রকৃত ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকল আর দ্বিতীয়ত, ক্রমেই পরীক্ষা-ফল-ডিগ্রি সনদমুখী শিক্ষার প্রকোপে এদের ছাড়াই নিম্ন থেকে উচ্চতর শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করল অথবা এগুলো থাকলেও ব্যবহার হ্রাস পেতে থাকল। তাতে কি শিক্ষক কি ছাত্র—কারও দিক থেকেই তেমন অভাববোধ হতে শোনা যায় না। অথচ মানুষই গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার স্বার্থে আরও অনেক সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল।

মুসলিম শাসকদের স্বর্ণযুগে নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়া, ইরান, স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলে ও উত্তর আফ্রিকার কিছু দেশে জ্ঞানচর্চার জোয়ার এসেছিল। এরই সূত্র ধরে ইউরোপের রেনেসাসে তা পরিপূর্ণতা পায়। এ সময় জ্ঞানচর্চার সূত্র ধরেই পশ্চিমে উচ্চতর গবেষণা ও পঠনপাঠনের সহায়ক নানা প্রতিষ্ঠান যেমন গড়ে উঠেছিল, তেমনি আবিষ্কৃত হয়েছিল জ্ঞানচর্চার উপযোগী সহায়ক অনেক যন্ত্রপাতি। এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার ছাড়াও রয়েছে জাদুঘর, মানমন্দির, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং নানা ধরনের বিষয়ভিত্তিক সংগ্রহশালা ও গবেষণাগার। আর মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ থেকে আজকের কম্পিউটার পর্যন্ত বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছে তারা।

আমাদের দেশে জাদুঘর বা চিড়িয়াখানাকে সাধারণজন বিনোদনকেন্দ্রের চেয়ে বেশি মূল্য দেয় না। পশ্চিমে স্কুল থেকেই শিশুশিক্ষার্থী এগুলোর সঙ্গে পরিচিত হয় এবং তাদের ভূমিকা সম্পর্কে জেনে যায়। এক সুহৃদের অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি। তিনি লন্ডনে ন্যাশনাল মিউজিয়ামে যাওয়ার সময় দেখলেন এক তরুণী মা তাঁর ক্রন্দনরত শিশুকন্যার মুখে হাতচাপা দিয়ে জাদুঘরের দুয়ার পেরোচ্ছেন। তিনি কাছে গিয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলে তরুণী মা শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন, এটি জাদুঘর, এর গাম্ভীর্য রক্ষার শিক্ষা তাকে শৈশব থেকেই পেতে হবে। পশ্চিমের যেকোনো দেশে, ইদানীং ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও দেখা যায়, স্কুলশিক্ষার্থীদের দল নিয়ে শিক্ষকেরা জাদুঘর, ঐতিহাসিক প্রত্নস্থান ইত্যাদি পরিদর্শন করছেন। আমাদের ময়নামতিতে শিক্ষাসফরের নামে মাইক বাজিয়ে পিকনিক পার্টির উৎপাত কয়েকবার স্বচক্ষে দেখে এসেছি।

রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রায়ই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার তাগিদ ও আশ্বাস শোনা যায়। এদিকে উন্নত বিশ্বে বর্তমানে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাল চলছে। আমরা নিশ্চয় ভুলে যাইনি পশ্চিমের প্রথম শিল্পবিপ্লবের পেছনে মূল চালিকাশক্তি ছিল বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ও উদ্ভাবন। এরই ধারাবাহিকতায় তারা প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে গত ৩০ থেকে ৪০ বছরে যে অগ্রগতি ঘটেছে, তা অবিশ্বাস্য। এদিকে আড়াই শ বছর আগে ইংরেজদের মাধ্যমে রেনেসাঁ-পরবর্তী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে আমাদের সংযোগ ঘটতে শুরু করে। তবে অনুশাসন ও সংস্কারে চালিত এ সমাজে বিজ্ঞানচেতনা ও চিন্তা ধারণের উপযোগী যথার্থ মানস গঠনে সম্ভবত আমরা এখনো সফল হইনি। আমরা যুক্তিচর্চা নিয়ে বিস্তর কথা বলি, বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজকেরা সব সময়ই বলেন, এতে যুক্তিবাদী মন তৈরি হবে। কিন্তু আদতে এও আমাদের মুখস্থবিদ্যারই এক সম্প্রসারণ।

একবার মফস্বলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমরা পৃথিবীর ভেতরে না বাইরে থাকি? তারা শেষ পর্যন্ত ভেবেচিন্তে উত্তর দিয়েছিল, পৃথিবীর ভেতরেই থাকি! এর মধ্যে ভালো এটুকু যে উত্তরটা তারা স্থির বিশ্বাস থেকে দেয়নি। সদুত্তর নিয়ে তাদের মনে ছিল সংশয়। তারা অনেকক্ষণ সন্দিগ্ধ মনে বিচার-বিবেচনা করে একটা উত্তরে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিল। মুখস্থবিদ্যা, তাও আবার পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরভিত্তিক মুখস্থবিদ্যায় ভর করে সাধারণ শিক্ষার্থী চট করে বলতে পারে না জোয়ার-ভাটা কেন হয়, পৃথিবী যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, তার কোনো প্রমাণ তুলে ধরতে পারে না। যদি বলা হয় মোগলদের মধ্যে আকবরই শ্রেষ্ঠ শাসক, তাহলে তার যথাযথ ব্যাখ্যা হাজির করতে পারে না অষ্টম-নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। কারণ, পরীক্ষানির্ভর শিক্ষায় কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ জানার দরকার পড়ে না, সে পড়ে শিক্ষক বা টিউটরের নির্দেশিত প্রশ্নের উত্তর, যা আকবরের কৃতির আংশিক ধারণা দিতে পারে। জ্ঞান খণ্ডিত, আংশিক, বিচ্ছিন্নভাবে অর্জিত হয় না। তার একটা পূর্ণতা যেমন দরকার, তেমনি তুলনামূলক আলোচনারও তো প্রয়োজন। যাঁদের তুলনায় আকবরকে শ্রেষ্ঠ বলা হচ্ছে, তাঁদের সম্পর্কে না জানলে এ কথা বলার অধিকার কি জন্মায়? আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরীক্ষার তুলনায় প্রকৃত জ্ঞানচর্চা প্রয়োজন বা গুরুত্বহীন। জ্ঞানচর্চা যেন অ্যামেচার বা শৌখিন বিষয়। ফলে বহুকাল ধরে আমরা অন্যের জ্ঞানের দাসত্ব করছি, তাদের জ্ঞানের অনুকরণ করছি, নিজেরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করতে পারছি না। জ্ঞানচর্চার দিক থেকে আমরা আজও পরাধীন রয়ে গেছি।

জ্ঞান বা জ্ঞানী সৃষ্টি নয়, ডিগ্রি-সনদ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেবল জ্ঞানের বোঝা বইছে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমেই প্রাণ হারাচ্ছে। আর এভাবে আমাদের অজান্তে জনসংখ্যার সবচেয়ে প্রাণবন্ত অংশটির সহজাত প্রাণশক্তি, কৌতূহল, অনুসন্ধিত্সা, জিজ্ঞাসার অপমৃত্যু ঘটতে থাকে। জ্ঞানের জগতে মৌলিক অবদানের জন্য যে সাহস প্রয়োজন, তা-ও অবশিষ্ট থাকে না।

কথাগুলো নানা সময় বলেছি, আবার বলতে হলো সম্প্রতি একটি টেলিস্কোপ কেনার অভিজ্ঞতার কারণে। সরকার স্কুলে স্কুলে ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ তৈরি করে দিচ্ছে, শুনেছি সব ছাত্রকে ছোট্ট কম্পিউটার বা ট্যাব দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের স্কুলে স্কুলে মাইক্রোস্কোপ, টেলিস্কোপ নেই। পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নের কিছু সাধারণ কিন্তু মজাদার পরীক্ষা হাতে-কলমে করার সুযোগ নেই। বহুকাল ধরে বিজ্ঞানের ল্যাবভিত্তিক কাজগুলো চরম ফাঁকি দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। কম্পিউটার অনেক কিছুই দিতে পারে। সচল ছবির মাধ্যমে জীবন্ত করে উপস্থাপন করতে পারে। কিন্তু তা কখনো স্বচক্ষে বাস্তবে দেখা এবং নিজের হাতে বাস্তবে করা ও চোখের সামনে ঘটতে দেখার অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনীয় নয়। শৈশব-কৈশোরে প্রত্যক্ষ বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপরই জোর দিতে হয়, নতুবা তাদের ইন্দ্রিয়গুলো এবং অভিজ্ঞতা অর্জন ও গ্রহণের দক্ষতা বিঘ্নিত হয়।

সম্প্রতি একটি ভালো মানের টেলিস্কোপ কিনতে গিয়ে দেখলাম, দেশে এটি পাওয়া যায় না। আকাশ দেখার বা দেখানোর কাজ করে এমন সংগঠনের এক কর্তাব্যক্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রায় ৫০ হাজার টাকা খোয়াতে বসেছিলাম। দুই বছরেও সব টাকা উদ্ধার হয়নি। নিজেরা বিদেশ থেকে কিনে আনার ক্ষেত্রেও কম জটিলতা নেই। যা হোক, প্রায় দুই বছর নানা পথে চেষ্টার পর প্রায় ৪৫ কেজি ওজনের টেলিস্কোপটি পাশের দেশের কলকাতা থেকেই কেনা সম্ভব হলো। এই ভারী যন্ত্রটি বিমানে আনার ক্ষেত্রে নানাজনের সাহায্য পেয়েছি। তবে জানি না তা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাপ্য নাকি তাদের বদান্য। তবু তাদের ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাতেই চাই। এবার এটি বাক্স থেকে খুলে সেট করার প্রশ্ন। দেখা গেল এমন মানুষ তেমন সুলভ নন। নির্ভরযোগ্য কাউকে পাওয়া তত সহজও নয়। এ বৃত্তান্তটুকু খুলে বললাম, এটুকু বোঝাতে যে জ্ঞানচর্চার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোও সহজ নয়। একটা টেলিস্কোপ কিনতে চেয়েছি এ কারণে যে বিজ্ঞান জাদুঘর বা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির টেলিস্কোপ চট্টগ্রামে এনে মহাকাশ দেখার কর্মসূচিতে শিশুদের আগ্রহ ও দীর্ঘ লাইন দেখে। বলা দরকার, অভিভাবকেরাও প্রকৃত তারকার রূপ একঝলক দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন, কিন্তু শিশুদের অগ্রাধিকার বজায় রাখতে গিয়ে প্রায়ই তাদের বঞ্চিত করতে হয়। তা ছাড়া, ঢাকা থেকে আনা-নেওয়ার ঝক্কি ও ব্যয় উভয়ই রয়েছে।

এত কথার পর একটুকু বলতে চাই যে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহারে নিশ্চয় পিছিয়ে থাকব না, কিন্তু বিজ্ঞানচর্চার যথার্থ অবকাঠামো তৈরি না করে এভাবে পরমুখাপেক্ষী থেকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরি অসম্ভব। আর দ্বিতীয় কথা হলো, কম্পিউটার সুলভ হওয়ার ফলে মাইক্রোস্কোপ ও টেলিস্কোপের মতো যন্ত্রগুলো জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তামাদি বা অকেজো হয়ে যায়নি। জাদুঘর, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেন বা প্রত্নস্থানে শিক্ষাসফরের গুরুত্ব কমেনি।

আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক