মক্কা মুকাররমা ও পবিত্র কাবা শরিফ

মক্কার প্রাচীন নাম বাক্কা। হজের কর্মসীমানাকে হারাম শরিফ বলে। হারাম মানে নিষিদ্ধ ও সম্মানিত। হারামাইন অর্থ দুটি হারাম বা দুটি সম্মানিত স্থান। মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফকে একত্রে হারামাইন শরিফাইন বলা হয়। পবিত্র মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফে অমুসলিমদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মক্কার হারাম শরিফের সীমানা হলো বাইতুল্লাহ শরিফের পশ্চিমে জেদ্দার পথে শুআইদিয়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার (১০ মাইল), পূর্বে জেরুজালেমের পথে ১৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার (৯ মাইল), দক্ষিণে তায়েফের পথে ১১ কিলোমিটার (৭ মাইল), উত্তরে মদিনা শরিফের পথে ৮ কিলোমিটার (৫ মাইল)। এ সীমানার মধ্যে জীবজন্তু শিকার করা নিষিদ্ধ। এমনকি গাছপালা, তৃণলতা ইত্যাদি ছেঁড়াও নিষেধ। হারাম শরিফের প্রাণকেন্দ্র হলো মসজিদুল হারাম, এর কেন্দ্রস্থলে কালো বর্ণের চতুষ্কোণ ঘরটিই হলো বাইতুল্লাহ শরিফ বা মহান আল্লাহর সম্মানিত কাবাঘর। হজরত আদম (আ.)-এর সময়কালেই কাবাঘরের সৃষ্টি।

হজরত নূহ (আ.)-এর সময় সংঘটিত মহাপ্লাবনের পর নবী ও রাসুল হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর ছেলে নবী ও রাসুল হজরত ইসমাইল (আ.) আল্লাহর নির্দেশে পুনরায় কাবাঘর সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেন। এযাবৎ কাবা শরিফ ১২ বার সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমান কাবাঘরের আয়তন পশ্চিমে ১০ দশমিক ১৫ মিটার (২২ হাত), পূর্বে ৮ দশমিক ৪০ মিটার (১৮ দশমিক ৫ হাত), দক্ষিণে ৮ দশমিক ২৪ মিটার (১৮ হাত), উত্তরে ৫ দশমিক ৫০ মিটার (১২ হাত) এবং উচ্চতা ৮ দশমিক ২৪ মিটার (১৮ হাত)।

মাকামে ইব্রাহিম একটি অলৌকিক পাথর। কাবা শরিফের পূর্ব-উত্তর পাশে সোনালি বেষ্টনীতে কাচঘেরা পায়ের ছাপযুক্ত যে পাথরখণ্ডটি সংরক্ষিত রয়েছে তা হলো মাকামে ইব্রাহিম। মাকাম অর্থ স্থান বা দাঁড়ানোর জায়গা। এ পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবাঘরের প্রাচীর গাঁথতেন। আল্লাহর কুদরতের মহিমায় এই পাথর প্রয়োজনমতো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সামনে-পেছনে আসা-যাওয়া এবং ওপরে-নিচে ওঠানামা করত। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘এতে রয়েছে মাকামে ইব্রাহিমের মতো প্রকৃষ্ট নিদর্শন। আর যে এর ভেতরে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে।’ (সুরা-৩ আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭)।

মাকামে ইব্রাহিমে নামাজ পড়ার জন্য হজরত উমর (রা.) প্রথম নবীজি (সা.)-এর কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। তখন আল্লাহ তাআলা ওহি নাজিল করে বলেন, ‘যখন আমি কাবা গৃহকে মানুষের জন্য সম্মিলনস্থল ও শান্তির আলয় করলাম, আর তোমরা ইব্রাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে মুছল্লা (নামাজের জায়গা) বানাও এবং আমি ইব্রাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, অবস্থানকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৫)। সকল প্রকার তাওয়াফের পর এই পবিত্র স্থানের কাছে দাঁড়িয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতে হয়। এই নামাজ ওয়াজিব।

কাবা শরিফের উত্তর পাশের অর্ধবৃত্তাকার দেয়ালঘেরা স্থানকে ‘হাতিম’ বলা হয়। এই স্থানটুকু আগে কাবাঘরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে নামাজ
পড়া মানে কাবাঘরের ভেতরে নামাজ পড়া। দোয়া কবুলের জন্য হাতিম উত্তম স্থান। হাতিমের ঠিক ওপরে কাবা শরিফে ঘরের ছাদের সঙ্গে একটা সোনার পরনালা আছে। বৃষ্টির সময় এই পরনালা দিয়ে ছাদের পানি পড়ে। সে জন্য এর নাম মিজাবে রহমত। মিজাবে রহমতের নিচে নামাজ পড়ে দোয়া করলে তা কবুল হয়।

বেহেশতি একটি পাথর হলো হাজরে আসওয়াদ। আসওয়াদ মানে কালো, হাজর মানে পাথর। এই কালো পাথরটি হজরত আদম (আ.) জান্নাত থেকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। এই পবিত্র প্রস্তরখণ্ডকে নবী করিম (সা.) অত্যন্ত বিনয় ও মহব্বতের সঙ্গে চুম্বন করতেন। এই পবিত্র পাথরের দৈর্ঘ্য ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। বর্তমানে এটি ছোট ছোট ১২টি খণ্ডে বিভক্ত, এর ৮ টুকরা দৃশ্যমান। এটি মাটি থেকে চার ফুট উঁচুতে কাবাঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে দেয়ালের বহির্দিকে প্রোথিত।

মক্কা শরিফে অবস্থানকালে নির্ধারিত ইবাদত ছাড়া সবচেয়ে বেশি পুণ্যময় ইবাদত হলো বাইতুল্লাহ শরিফ তথা খানায়ে কাবা তাওয়াফ করা। কাবাঘর সাতবার প্রদক্ষিণ করলে এক তাওয়াফ হয়। তাওয়াফ ডান দিক থেকে বাঁ দিকে করতে হয়। ফরজ ও ওয়াজিব তাওয়াফ ছাড়াও নফল তাওয়াফ অত্যন্ত ফজিলতের আমল। নামাজের সময় ছাড়া সব সময় তাওয়াফ করা যায়।

মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক

smusmangonee@gmail,com