'কেন তারা এভাবে ছেলেটাকে মেরে ফেলল?'

সাইদুর রহমান পায়েল। ছবি: সংগৃহীত
সাইদুর রহমান পায়েল। ছবি: সংগৃহীত

খবরটি প্রথমে পড়েই অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। চট্টগ্রাম থেকে দুই বন্ধু হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাসে ঢাকা আসছিলেন, যাঁরা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। রাত সাড়ে চারটায় গজারিয়ায় বাসটি যানজটে পড়লে তাঁদের একজন সাইদুর রহমান পায়েল প্রক্ষালন করার কথা বলে বাস থেকে নেমে যান। এ সময় তাঁর বন্ধু বাসটিতে ঘুমাচ্ছিলেন।

এরই মধ্যে যানজট ছুটে গেলে বাসটি তাঁকে না নিয়েই ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। পরে ভবের চরের নদীতে তাঁর লাশ পাওয়া যায়। তখন ধারণা করা হয়েছিল, পায়েলকে একা পেয়ে হয়তো দুর্বৃত্তরা তাঁকে হত্যা করেছে। পায়েলের বন্ধুকে এই গল্পই বলেছিলেন বাসের চালক, সহকারী ও সুপারভাইজার। পকেটে থাকা মানিব্যাগে রাখা টেলিফোন নম্বর থেকে পায়েলের পরিচয় জানা যায়।

পরবর্তীকালে তদন্তে যে তথ্য বেরিয়ে আসে, তা ভয়ংকর। বাসটি ছেড়ে দিলে পায়েল দৌড়ে উঠতে গিয়ে মারাত্মক আঘাত পান। তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় বাসের তিন কর্মচারী আহত পায়েলকে বাসে না তুলে পাশের সেতু থেকে নিচে ফেলে দেন এবং পরদিন তাঁর লাশ ভেসে ওঠে।

কোনো মানুষ কি এত নৃশংস হতে পারে? তাঁরা পায়েলকে বাসে নিতে না চাইলে পাশের কোনো ক্লিনিক/ডিসপেনসারি/হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারতেন। এ ব্যাপারে তাঁরা যাত্রীদের সহায়তাও নিতে পারতেন। সেটাও যদি করতে না পারতেন, তাঁরা পায়েলকে তাঁর সঙ্গে আসা বন্ধুকে ডেকে তাঁর জিম্মায় দিয়ে চলে আসতে পারতেন।

কিন্তু সেসব না করে পরিবহনকর্মী নামের তিন দুর্বৃত্ত গুরুতর আহত পায়েলকে সেতুর ওপর থেকে নিচে ফেলে দিলেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তাঁদের দুজন ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, পায়েল বাস থেকে পড়ে যাওয়ার পর তাঁরা মনে করেছেন তিনি মারা গেছেন।

কেউ মারা গেলেই কি তাকে সেতু থেকে ফেলে দিতে হবে? গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, পায়েলের পেটে প্রচুর পানি পাওয়া গেছে। এর অর্থ নদীতে ফেলে দেওয়ার পরও তিনি বেঁচে ছিলেন। মৃত মানুষের পেটে পানি ঢোকে না। একজন জীবন্ত মানুষকে সেতু থেকে ফেলে দেওয়ার অর্থ পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। দুর্বৃত্তরা তাঁকে খুন করেই ক্ষান্ত হননি, পায়েলের বন্ধুকে জানিয়েছেন, তিনি পরের বাসে আসবেন। খুন করার পরও ঠান্ডা মাথায় তাঁরা সবকিছু করেছেন।

যাত্রীদের নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া যাঁদের দায়িত্ব, তাঁরাই কি না একজন যাত্রীকে সেতু থেকে ফেলে দিলেন? হানিফ এন্টারপ্রাইজ একটি বহুল পরিচিত বেসরকারি পরিবহন সংস্থা। সারা দেশেই সংস্থাটি যাত্রী পরিবহন করে থাকে। সেই পরিবহনের বাসে তিন দুর্বৃত্ত কীভাবে চাকরি পেলেন? পায়েল হত্যার জন্য যে তিন দুর্বৃত্তকে ধরা হয়েছে, তাঁদের দুজন ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা উচিত এর আগেও তাঁরা আরও কত যাত্রীকে এভাবে বাস থেকে ফেলে দিয়ে কিংবা অন্য কোনো উপায় খুন করেছেন। অপকর্মে হাত না পাকালে এত বড় নৃশংস ঘটনা তাঁরা ঘটাতে পারতেন না।

এর আগেও বিভিন্ন পরিবহনে যাত্রী হয়রানি ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর আগস্টে রূপা নামের এক যাত্রী চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে বগুড়া থেকে টাঙ্গাইলের মধুপুরে আসছিলেন। বাসের অন্য সব যাত্রী আগের গন্তব্যে নেমে গেলে ছোঁয়া পরিবহনের ৫ কর্মী তাঁকে প্রথমে ধর্ষণ করেন। পরে সেই অপরাধ ঢাকতে তাঁরা রূপাকে হত্যা করেন। সেই ঘটনায় অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছেন।

বাস থেকে যাত্রীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া, উঠতে বাধা দিতে গিয়ে বাসের নিচে ফেলা কিংবা দুই বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে যাত্রীর প্রাণ হারানোর ঘটনা অহরহ ঘটছে। এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে মন্ত্রী ও পরিবহনের মালিকেরা বাসযাত্রীদের অসচেতনতাকে দায়ী করেন। গরু-ছাগল চিনলেই গাড়ি চালাতে পারেন বলে সার্টিফিকেট দেন। কিন্তু পরিবহনকর্মী নামের দুর্বৃত্তরা যে যাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্দয় আচরণ করে থাকেন, সে বিষয়ে তাঁরা টুঁ শব্দ করেন না। অনেক সময় মালিকেরা পরিবহনকর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য করেন। আমরা তার নিন্দা করি। তাঁদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দেওয়ার দাবিকেও সমর্থন করি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তাঁরা যাত্রী হত্যার লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। হানিফ পরিবহনের তিনি কর্মী একজন আহত ও রক্তাক্ত যাত্রীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে সেতু থেকে ফেলে খুন করেছেন। তাঁরা মানুষ নামের অযোগ্য। আমরা যাদের ইতর প্রাণী বলি, তাদেরও একটি ধর্ম আছে। কিন্তু এই দুই পেয়ে ইতর প্রাণীদের কোনো ধর্ম নেই। মনুষ্যত্বও নেই।

পায়েলের মাকে এখন আমরা কী সান্ত্বনা দেব? পায়েল যাত্রার সময় তাঁকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা কোরো না মা, আমি ঢাকায় গিয়ে টেলিফোন করব।’ মাকে আর কখনো টেলিফোন করবেন না পায়েল। সৌদিপ্রবাসী বাবাও দেশে এসে তাঁর প্রিয় পুত্রের মুখও দেখতে পাননি। কেননা আহত হয়ে ও পানিতে ডুবে তাঁর লাশটি বিকৃত হয়ে গেছে। মায়ের শেষ আর্তি, যাঁরা পায়েলকে খুন করেছেন, মা একবার তাঁদের দেখতে চান। তাঁদের একটি কথাই বলতে চান, ‘কেন তারা এভাবে ছেলেটাকে মেরে ফেলল?’

যাঁরা একজন আহত যাত্রীকে চিকিৎসা না দিয়ে সেতু থেকে ফেলে হত্যা করতে পারেন, সেই পাষণ্ডদের হাতে যাত্রীরা নিরাপদ নয়। যাত্রীসেবার নামে যেসব পরিবহনকর্মী মানুষ খুন করেন, তাঁদের সবাইকে পাকড়াও করা হোক। সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হোক।

আসুন আমরা আর নিশ্চুপ না থেকে প্রতিবাদ করি। হত্যাকারীদের ঘৃণা করি।