ভোট এলেই ছোট দলের কদর বাড়ে

বাংলাদেশে জোটের রাজনীতির শুরু ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক নির্বাচনী জয়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে মিল না হওয়ায় তারা একত্র থাকতে পারেনি। ফ্রন্টের দুই প্রধান শরিক আওয়ামী লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টি আলাদা হয়ে যায়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ভেঙে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠিত হয়। ষাটের দশকের শুরুতে ও শেষে বিরোধী রাজনীতিকেরা আরেকবার জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন আইয়ুব শাহিকে হটাতে। সেই জোটও টেকসই হয়নি। কারণ, তাদের মধ্যে আদর্শগত ঐক্য ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশেও জোটের রাজনীতি যতটা না আদর্শকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতাকেন্দ্রিক। কিছুটা ব্যতিক্রম দেখেছিলাম ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি মিলে গণতান্ত্রিক জোট গঠনের সময়। ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতার ভাগীদার না হয়েও ঐক্য করেছিল ‘বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে।’

পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে-বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারায়। জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের আগেই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন কয়েকটি কট্টর বাম ও কট্টর ডানপন্থী দল নিয়ে। পরে তারা একীভূত হয়ে যায় বিএনপি নামক দলে। সে সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রথমে গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট, পরে ৯-দলীয় জোট গঠিত হয়। এরশাদের শাসনামলেও বিরোধী রাজনীতি দুই ধারায় প্রবাহিত হতো আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের নেতৃত্বে ১৫-দলীয় জোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭-দলীয় জোট। এরশাদের পতনের লক্ষ্যে ঘোষিত হয় তিন জোটের রূপরেখা; যা আমাদের গণতন্ত্রের ভিত্তি হতে পারত। কিন্তু নির্মম সত্য হলো সেটি হয়নি। তিন জোটের রূপরেখা এখন পরিত্যক্ত সম্পত্তি।

নব্বই-পরবর্তী রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো কোনো দলই এককভাবে সরকার গঠন করতে পারেনি। স্বৈরাচারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি যে নির্বাচন হয়, সেই নির্বাচনে বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সরকার গঠন করতে হয় জামায়াতের সমর্থন নিয়ে। একইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সফল হলেও ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভে ব্যর্থ হয়। দলটি জাতীয় পার্টি ও জাসদের সহযোগিতায় সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে; শুরুতে এই জোটে আজ আওয়ামী লীগের ক্ষমতার শরিক এরশাদও ছিলেন। সেবার আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করে মাত্র ৬২টি আসন পায়।

এরপর আর আওয়ামী লীগ এককভাবে নির্বাচন করার ঝুঁকি নেয়নি। ২০০৬ সালে তারা গঠন করেছিল মহাজোট, যাতে সাবেক স্বৈরাচার ও বাম-মধ্য সব দলই ছিল। কিন্তু বিএনপির একগুঁয়েমির কারণে ২০০৭ সালের নির্বাচনটি হতে পারেনি, যার খেসারত দলটিকে এখনো দিতে হচ্ছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয়ের পরও জোটের রাজনীতি বহাল রাখে। তাদের এক হাত ধরে আছে বামেরা, অন্য হাত ‘রাষ্ট্রধর্মের প্রবক্তা’। অন্যদিকে বিএনপি জোটে ইসলামপন্থীদের সংখ্যাই বেশি। তবে এই দ্বিমুখী জোট রাজনীতির মহিমা এমনই যে আওয়ামী লীগের শরিকেরা নৌকায় চড়ে বসেছেন, আর বিএনপির শরিকেরা ধানের শীষে আশ্রয় নিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জামায়াতে ইসলামী বরাবর নিজের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছে। যদিও নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় দলটি নিজের নাম ও প্রতীকে নির্বাচন করার যোগ্যতা হারিয়েছে।

ডিসেম্বরের (ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে এই সময়ের কথাই বারবার বলা হচ্ছে) জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে নতুন করে মেরুকরণের নানা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসরাম আলমগীর অনেক আগেই ক্ষমতাসীন মহলের বাইরের সবাইকে নিয়ে বৃহত্তর জোটের কথা বলে আসছিলেন। ২০-দলীয় জোট তো আছেই। তিনি বিকল্পধারা, গণফোরাম, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, নাগরিক ঐক্য ইত্যাদি দলের নেতাদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে আওয়ামী লীগও নড়েচড়ে বসে। গত কয়েক দিনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রথমে যান সিপিবি কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাতে, পরদিন জনতা লীগের কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গেও তাঁর মোলাকাত হয়। এ ছাড়া টেলিফোনেও কয়েকটি দলের নেতার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সম্প্রতি আরও তিনটি জোটের তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে। একটি হলো তৃতীয় ধারার নামে পাঁচটি দলের এক হওয়ার চেষ্টা, যার মধ্যে রয়েছে অধ্যাপক বি চৌধুরীর বিকল্পধারা, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, আ স ম রবের জেএসডি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য, কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি থেকে সমদূরত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনের আগাম ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত কার সঙ্গে যুক্ত হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। বিএনপি যদি আগামী নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে তৃতীয় ধারার অঙ্গীকার ঘোষণাকারী দলগুলোর এক রকম অবস্থান হবে, আর বিএনপি নির্বাচনে না গেলে অন্য রকম।

দ্বিতীয় জোট হলো বাম গণতান্ত্রিক জোট, যার সদস্য হলো সিপিবি, বাসদ, বাসদ মার্ক্সবাদী, গণসংহতি আন্দোলন, সমাজবাদী দল, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন। এ ছাড়া সাবেক বিএনপি নেতা নাজমুল হুদার নেতৃত্বে আরকেটি জোট আওয়ামী লীগের সঙ্গে গাঁটছড়া বাধার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের জোট রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলো প্রধান দলের ইচ্ছায় সবকিছু হয়ে থাকে। তারা যেভাবে চায়, সেভাবেই জোট চলে। অন্যান্য দলের ‘জি-হ্যাঁ’ বলা ছাড়া কোনো ভূমিকা থাকে না। বড় দলের নেতাদের কথাবার্তায় বরাবর অহংবোধ প্রকাশ পেয়ে থাকে, তবে সেটি কখনো কখনো এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে শরিকেরা নিশ্চুপ থাকতে পারে না। জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু একবার বলেছিলেন ‘আমরা যদি এক পয়সার মালিক হয়ে থাকি, সেটা নিয়েই আপনারা ষোলো আনা। এক পয়সা চলে গেলে ষোলো আনারও কোনো মূল্য থাকবে না। ক্ষমতার বাইরে সবার অবস্থানই সমান হবে।’ আদর্শ নয়, ক্ষমতাই তাদের একবৃন্তে নিয়ে এসেছে।

রাজনৈতিক জোট হয় কতগুলো নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির ভিত্তিতে। সেই নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচি সব সময় শরিক দলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলবে না। আবার পুরোপুরি অমিলও হতে পারে না। বিএনপি নেতাদের দাবি, জামায়াত বিএনপির আদর্শিক মিত্র নয় কৌশলগত মিত্র। আবার আওয়ামী লীগের নেতারা বলে বেড়ান, তাদের আদর্শিক জোট ১৪ দল। এরশাদের সঙ্গে সম্পর্কটি নিছক কৌশলগত। অর্থাৎ কৌশলের কাছে আদর্শ মার খাচ্ছে।

২০০৪ সালে আবদুল জলিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে ১৪-দলীয় জোট গঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন, একসঙ্গে সরকার গঠন। কিন্তু ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ জোটের শরিক সব দলকে সঙ্গে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এরশাদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করেছে।

নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জোটের রাজনীতি আরও স্পষ্ট হবে। বড় দলগুলোর নেতারা ছোট দলগুলোর কাছে ধরনা দেবেন, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ভোট শেষ হলে তাঁদের কথা কতটা মনে রাখবে, সেটাই আসল প্রশ্ন। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সিপিবিসহ কয়েকটি বাম দল অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ব্র্যাকেটবন্দী করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁরা ভেবে দেখেননি যে এই বাম দলগুলো জামায়াত ও মৌলবাদবিরোধী নীতি থেকে একচুল ও আসেনি। তাঁরা চাইছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ পরিচালিত হোক। অর্থনীতিতে লুটেরাদের দৌরাত্ম্য রহিত হোক। তাঁরা চাইছেন বাংলাদেশ বাহাত্তরের মূল সংবিধানে ফিরে যাক।

আওয়ামী লীগ ১৪-দলীয় জোটের বাইরের আরও দলকে নিয়ে জোটের পরিসর বাড়াতে চায়। কিন্তু তারা নীতিভ্রষ্ট এরশাদ ও পথভ্রষ্ট নাজমুল হুদাদের সঙ্গে সুবিধাবাদী জোট করলে বামেরা না-ও আসতে পারে। তবে আওয়ামী লীগ চাইছে বামেরা তাদের জোটে না আসুক ক্ষতি নেই। কিন্তু বিএনপির জোটে যেন না যায়। একই চাওয়া বিএনপিরও। তারাও মনে করে, জামায়াতের কারণে প্রস্তাবিত যুক্তফ্রন্ট বিএনপির সঙ্গে না-ও আসতে পারে। অন্তত তারা আওয়ামী লীগ থেকে দূরে থাকুক।

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com