ভোটের আগেই ভয়!

কোলাহলমুক্ত শান্ত শহর রাজশাহী এখন নির্বাচনী প্রচারণায় মুখর। বেলা দুইটা থেকে শুরু হয় মাইক বাজানো, চলে রাত আটটা পর্যন্ত। সারা বেলা সারা শহর ঘুরে ঘুরে প্রচার চালিয়ে সন্ধ্যার দিকে সব প্রার্থীর সবগুলো মাইক যেন এসে জড়ো হয় জিরো পয়েন্ট বা কেন্দ্রীয় অংশে। তারপরের অন্তত দু-তিন ঘণ্টা সাহেব বাজার ও এর আশপাশের এলাকাগুলোর মানুষের কান ঝালাপালাদশা চলে।

আটটা বাজতেই ঝপ করে নীরবতা নেমে আসে। তারপর দ্রুত ঘনিয়ে আসতে থাকে রাত। সব কোলাহল থেমে যায়। রাত সাড়ে ১০টায়, কোলাহলশূন্য সাহেব বাজারে দেখতে পেলাম ছোটখাটো মানুষটাকে। একটা খালি রিকশার পাশে দাঁড়িয়ে আয়েশ করে সিগারেট টানছিলেন। তাঁর পাশেই নানা জাতের গাছগাছালির চারা বিক্রির খোলা দোকান। তরুণ দুই দোকানি দোকান গোটানোর আয়োজন করছিলেন।

ভোট কেমন হবে? ধূমপানরত লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি হেসে বললেন, ভোট যেমন হয়, তেমনই হবে। তাঁর উক্তিটা সরল ঠেকল না। লোকটি বয়স্ক, ছোটখাটো হাসিখুশি মানুষ। চুল সব সাদা। থুতনিতে একটুখানি দাড়ি, ফ্রেঞ্চ কাটের মতো, তাও একদম সাদা।

আপনার নাম কী?

‘আবদুর রশিদ।’

বয়স?

‘সত্তর বছর।’

এই রিকশা আপনার?

‘হ্যাঁ।’

সত্তর বছর বয়সে রিকশা চালান, আবার সিগারেটও খান?

‘গাঁজা-ভাং খাই না। নেশা আমার এই একটাই।’

আচ্ছা, ভোটের কথা বলেন। বাতাস কোন দিকে?

‘আমি হলাম আওয়ামী লীগের বংশ। আমাকে বুললে তো আমি বুলব, বাতাস লিটন সাহেবের দিকেই।’

আপনি আওয়ামী লীগের বংশ, এই কথার মানে কী?

‘দেশের জন্য সংগ্রাম করেছি...।’

আপনি মুক্তিযোদ্ধা?

‘সে কথা তো এখন বুলে লাভ নাই। বুললে বুলবেন কোথায় কোথায় যুদ্ধ করেছেন, কার কার সাথে যুদ্ধ করেছেন। প্রমাণ দিতে হবে। আমরা যখন যুদ্ধ করেছি, তখন কি ভেবেছিলাম যে একদিন প্রমাণ দিতে হবে? তখন কি এত কিছু বুঝতাম?’

আচ্ছা, আপনি যদি আওয়ামী লীগের বংশ না হতেন, তাহলে ভোট সম্পর্কে কী বলতেন? সত্যিকারের অবস্থাটা কী?

‘রাজশাহী তো বিএনপির ঘাঁটি। বুলবুল সাহেবেরই জেতার কথা। কিন্তু মনে হয় জিততে পারবে না।’

কেন?

‘এত কিছু তো বুলতে পারব না। বেশি কথা বুললেই ধরে লিয়ে যেতে পারে। কত লোককে ধরে লিয়ে গেছে।’

যাদের ধরেছে, তারা তো বিএনপি-জামায়াতের লোক। আপনি তো আওয়ামী লীগের বংশ।

এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে রিকশাচালক আবদুর রশিদ অভিযোগ করলেন, ‘রিকশা রিনিউ (লাইসেন্স) করতে আগে লাগত চার শ টাকা, এখন বাড়িয়ে করেছে সাত শ টাকা। নতুন মেয়র আসবে, আবার বাড়াবে। তারপর আবার বাড়াবে। আমরা গরিব মানুষ কষ্ট করব, আর তারা ধনী হবে। ধনী হতেই থাকবে। কাউন্সিলর ভোটে পাস করলেও কোটিপতি হয়ে যায়।’

গাছের চারা বিক্রেতা তরুণদের একজনকে বললাম, ভোটের হাওয়া কোন দিকে? তিনি লাজুক হাসলেন, কিছু বললেন না। তাঁর পাশের জন বললেন, ‘দুই পক্ষেই অনেক ভোটার। দেখা যাক।’

আমি বললাম, এটা কি আপনি মন থেকে বললেন? এই তরুণও হাসলেন। তিনিও আর কিছু বললেন না।

তিনজন ফলের দোকানি পরপর বললেন, নৌকা মার্কা জিতে যাবে। জানতে চাইলাম, কারণ কী। উত্তরে একজন বললেন, ‘কারণ সরকারি দল।’

আমি বললাম, ‘সরকারি দল বলেই মানুষ ভোট দেবে?’

যাঁর সঙ্গে কথা চলছিল, তাঁর পাশের জন হেসে বললেন, ‘ইলেকশানে জিতার সাথে ভোটের কোনো সম্পর্ক আছে?’

আমি বললাম, মানে?

ওই দোকানি আর কিছু বললেন না। অবশ্য তাঁর চোখেমুখে হাসির ভাবটা লেগেই রইল। সম্ভবত আমাকে বোকা ভেবে। মনে পড়ল, বিকেলে রাস্তার পাশে এক ঘড়ির দোকানে ক্রেতা নেই দেখে দোকানির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একই রকমের মন্তব্য শুনতে পেয়েছিলাম। ৩০ বছরের যুবক দোকানি নিজের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ভোট যে রকমই হোক না কেন, নৌকা মার্কাই জিতবে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন, রাজশাহীতে ধানের শীষের সমর্থক কি কম? উত্তরে তিনি আমাকে বলেছিলেন, বুলবুল সাহেবের সমর্থক অনেক। কিন্তু তাদের অনেককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। আর অন্যরা ভয় পেয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে।

সন্ধ্যার দিকে তৈরি পোশাকের এক দোকানির সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলাপ করার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি যদি জনে জনে জিজ্ঞাসা করি ভোটের ফল কী হবে, তাহলে সম্ভবত একটাও আন্তরিক উত্তর পাব না। কারণ, তাঁর ধারণা, এ বিষয়ে কেউই মনের কথাটা বলবে না। অধিকাংশ মানুষই বলবে, লিটন সাহেব জিতে যাবেন। কারণ, এটা বলাই সব থেকে নিরাপদ। বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেবেন, এমন ব্যক্তিরাও অবলীলায় বলতে পারেন যে লিটন সাহেবই জিতে যাবেন। এই আবাসিক হোটেলের িনরাপত্তাকর্মী বললেন, ‘সবাই তো নৌকা নৌকা করছে।’

মঙ্গলবার বিকেল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শ খানেক মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে। যাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁরা একেবারেই সাধারণ মানুষ; বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন পেশার। অধিকাংশই পুরুষ; ছয় বা সাতজনের বেশি নারীর সঙ্গে কথা হয়নি।

কথা বলার সময় প্রথমেই যে বিষয়টি আমার নজরে এসেছে তা হলো, নির্বাচন বিষয়ে কথা বলায় অনিচ্ছা। কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচন নিয়ে খোলামেলা কথা বললে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। যাঁরা কথা বলেছেন, তাঁরা সবাই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন, শুধু রিকশাচালক আবদুর রশিদ ছাড়া। ছবি তুলতে দিতে রাজি হননি কেউই। যঁারা আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাঁরা হয়তো সব কথা মন থেকে বলেননি।

বিএনপির নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, মামলা, পুলিশি হয়রানি ইত্যাদি কারণে সার্বিকভাবে একটা ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় রাজশাহীর জনগণের মনে এমন একটা সাধারণ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে এসবের উদ্দেশ্য হলো আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকার-সমর্থিত প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটনের বিজয় নিশ্চিত করা; অর্থাৎ ইতিমধ্যে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে রাজশাহীর অনেক মানুষ মনে করছেন। এরপর নির্বাচনে খায়রুজ্জামান লিটন বিজয়ী হলে এসব মানুষ ভেবে নেবেন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি, পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে। শতভাগ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বোচ্চসংখ্যক ভোট পেয়েও যদি খায়রুজ্জামান লিটন বিজয়ী হন, তবু রাজশাহীর মানুষের একটা বড় অংশের এই ধারণা দূর করা কঠিন হয়ে পড়বে।

নির্বাচনের লিগ্যালিটির মতোই গুরুত্বপূর্ণ তার লেজিটিম্যাসি বা গ্রহণযোগ্যতা। ৩০ জুলাই অনুষ্ঠেয় রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন আইনগত দিক থেকে কেমন হবে জানি না, তবে তার লেজিটিম্যাসি যে ইতিমধ্যেই বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা রাজশাহীবাসীর কাছে খুব স্পষ্ট। 

মশিউল আলম, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]