প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকদের বদলির প্রস্তাব কেন?

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাদের শিক্ষা পদ্ধতি প্রশংসিত হয় দেশে–বিদেশে। ​এই ইতিবাচক প্রতিবেদনটি উঠে আসে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারির প্রথম আলোয়। অর্জনের পেছনে ছিল প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায়।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম প্রাথমিক বিদ্যালয় শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। তাদের শিক্ষা পদ্ধতি প্রশংসিত হয় দেশে–বিদেশে। ​এই ইতিবাচক প্রতিবেদনটি উঠে আসে ২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারির প্রথম আলোয়। অর্জনের পেছনে ছিল প্রধান শিক্ষকের দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায়।

সদ্য সমাপ্ত জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে জেলা প্রশাসকেরা প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে জন্য প্রস্তাব রেখেছেন। মাঠপর্যায়ে দীর্ঘ কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে দেওয়া সেসব প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, বিবেচনা করা হয় আন্তরিকতার সঙ্গে। সেটাই রেওয়াজ, সেটাই তরিকত। এবার জেলা প্রশাসকেরা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নতির একটা তরিকা বাতলেছেন। তাঁদের মতে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের তিন বছর অন্তর অন্তর এক বিদ্যালয় থেকে আরেক বিদ্যালয়ে বদলি বাধ্যতামূলক করলে শিক্ষার নাকি উন্নতি হবে। এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাবের পেছনে যুক্তির কোনো বয়ান প্রকাশিত হয়নি। নির্ভরযোগ্য সূত্রে কারণ ও যুক্তির বর্ণনা পাওয়া না গেলে মানুষ লোককথা, কানকথা, গুজব ইত্যাদির ওপর ভর করে যে যার মতো উপসংহার টানে। আর সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে যাঁদের জীবন-সংসার প্রভাবিত হবে, তাঁরা নানা দুশ্চিন্তায় জেরবার হতে থাকেন।

অনেকে মনে করেন, অনেক প্রধান শিক্ষক তাঁদের বিদ্যালয়ের এলাকায় গেড়ে বসেন। ‘ভিলেজ পলিটিকসে’ মাতোয়ারা হয়ে নানা ফায়দা লুটতে লুটতে একসময় ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকেন। বিদ্যালয়ের কাজে মন থাকে না, নালিশ-সালিসের ধান্দায় দিন কাটে তাঁদের। কাজেই তাঁদের দৌড়ের মধ্যে রাখতে হবে। বদলির চাকরিতে শিকড় গজানোর সুযোগ থাকে না, কাজেই বদলিই এসব ‘অনাচারের’ একমাত্র ওষুধ।

এহেন বদলির আবদারের পেছনে কোনো সমীক্ষা এবং ফলাফল আছে কি? না পুরাটাই একটা ধারণাপ্রসূত বা বিরাগ থেকে জন্ম নেওয়া, যৌক্তিক চিন্তাবর্জিত হঠকারী প্রস্তাব? জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমে একজন অবসরে থাকা সিনিয়র আমলা সাদামাটা প্রশ্ন করেছিলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একই বিদ্যালয়ে তিন বছরের অধিক থাকলে ক্ষতি কার? একেবারে দাঁত বসানো উত্তরে আসে, আপনি জেলা প্রশাসক হননি, তাই বুঝবেন না! জেলা প্রশাসক হতে না পারা সেই রাজকর্মচারী তাঁর জানা দুটি বিদ্যালয়ের উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা একটা দীর্ঘমেয়াদি আরাধনার মতো বিষয়। এখানে ছেদ বা বিরতি আখেরে ভালো ফল ফলতে দেয় না।

পাবনা জেলার ঈশ্বরদীর অরণকোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮০ দশকের শেষে রাজশাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয় ছিল। প্রধান শিক্ষকের নেতৃত্বে শিক্ষকেরা টিমওয়ার্কের মাধ্যমে স্কুলটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক অনন্য মাত্রায়। স্থানীয় আমলারা উপজেলার আরও বেশি স্কুলকে সমমাত্রায় উন্নীত করতে অরণকোলার শিক্ষকদের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বদলি করলেন। ফলাফল, অরণকোলা নেমে গেল গয়রহ মাত্রায়। অন্যরা যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দইয়ের বীজ নন যে জমে থাকা এক দইয়ের ভাঁড় থেকে এক চামচ নিয়ে দুধের হাঁড়িতে রেখে দিলেই দুধ জমে দই হয়ে যাবে!

এই শতকের প্রথম দশকে নরসিংদী জেলার মনোহরদী মডেল প্রাইমারি স্কুল সারা দেশের মধ্যে সেরা ফল করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। এক তরুণী প্রধান শিক্ষিকা স্কুলটির লেখাপড়া ও ক্রীড়া-সংস্কৃতির মান বাড়ানোর জন্য শিক্ষক-অভিভাবকদের নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজ করে এই অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেন। উপজেলার কোনাকাঞ্চি থেকে অভিভাবকদের ঢল নামে মনোহরদী শহরে। সন্তানের জন্য ভালো মানের শিক্ষার নিশ্চিত করতে ওই স্কুলে ভর্তি করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। স্থানীয় শিক্ষা কর্মকর্তারা সেই চাপ ঠেকানোর জন্য অন্য স্কুলগুলোকে উল্লেখিত মডেল প্রাইমারি স্কুলের পাঠদান ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করার উপদেশ না দিয়ে সফল স্কুলটির প্রধান শিক্ষিকাসহ অন্যদের আশপাশের স্কুলে বদলির পরিকল্পনা করেন। শত বছরের পুরোনো বিদ্যালয়টি কোন জাদুবলে শ্রেষ্ঠ স্কুল হলো আর অন্যরা কেন পারছে না, তার শুলুক-সন্ধান না করে বদলির মাধ্যমে ‘ভালো বীজ’ ছড়িয়ে দিয়ে উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন। ভালো বীজ ভালো ফসল তখনই নিশ্চিত করে, যখন সে সঠিক মাত্রায় জল, হাওয়া, পরিবেশ আর পরিচর্যা পায়। একটা স্কুলের ফল হঠাৎ করে ভালো হয় না। প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলে পঞ্চম শ্রেণি পার করায়। নতুন একজন প্রধান শিক্ষক এলে—তা তিনি যত ভালো ও অভিজ্ঞই হোক না কেন—নতুন স্কুলের শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়বেই। এটা শুধু প্রাথমিকের ক্ষেত্রে নয়, মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়েও প্রযোজ্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট পরিপক্ব হলেও তাঁদেরও সেই ধারাবাহিকতার প্রয়োজন আছে। সেবার শেষ পর্যন্ত বদলি ঠেকানো গিয়েছিল, কিন্তু শিক্ষকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার ভাটা ঠেকানো যায়নি। বদলির খড়্গ মাথার ওপর ঝুলতে থাকলে স্বল্প বেতনের শিক্ষকেরা কাজে মন দেবেন কীভাবে?

কোনো কোনো শিক্ষক কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতীকে পরিণত হন, যাঁদের কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। পাঠকের মানসদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই ভেসে উঠছে এমন কিছু আইকনের নাম, যাঁদের বাদ দিয়ে সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কল্পনাই করা যায় না। যেমন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে এককভাবে শ্রেষ্ঠ স্কুলের মুকুটে সম্মানিত শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জনাব নুরুল আলম খান। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার এই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৬ সালে। (২০১৬ সালে প্রথম আলো এই স্কুলের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে)। একসময় বাংলাদেশের বাইরেও তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এমন একটা সময় ছিল, যখন এই স্কুলে যেই ভর্তি হতো সেই প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুল বা মেধা কোটায় (কোটা শব্দটি ব্যবহারের জন্য দুঃখিত) বৃত্তি লাভ করত। সারা দেশ থেকে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানদের শিবরাম স্কুলে পাঠিয়ে নিশ্চিত হতে চাইতেন। সেই চাপ সামলাতে শেষ পর্যন্ত এই প্রাথমিক স্কুলে শিশুদের জন্য হোস্টেল খুলতে হয়। স্কুলটিকে নুরুল আলম সাহেব এমনই আনন্দময় করে তুলেছিলেন যে ছুটির ঘণ্টা পড়লে শিক্ষার্থীদের মন খারাপ হয়ে যেত। গ্রামবাসী তাঁদের অর্থ দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, লোকবল দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁকে সহায়তা দিয়েছেন। নুরল আলম সাহেবকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলাম, আপনাকে তিন বছর পরপর বদলি করলে স্কুলটাকে কি ওভাবে গড়তে পারতেন? ফোনে তাঁর একটা হাসি শুনলাম। সে হাসির নানা মানে হতে পারে। পরে তিনিই আমাকে উল্টো প্রশ্ন করলেন, কীভাবে পারতাম? তবে তিনি পোক্ত নজরদারির কথা বললেন, বললেন কতিপয় ফাঁকিবাজ শিক্ষকের কথা, তাঁদের ঝুলিয়ে রাখার কোনো মানে হয় না। সরিয়ে দেওয়াই ভালো। সবার জন্য একই সমাধানের ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার কালচার থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আর যেন তুঘলকি কাণ্ড না হয়। ডিসিদের হাতে এখন খবরদারি করার মতো কিছু নেই। বিচার, আইনশৃঙ্খলা কিছুই নেই। প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির দায়িত্ব পেলে খবরদারি করা যাবে, এ জন্যই কি বদলির পথ বাতলাচ্ছেন? অনেক ধরনের বাণিজ্যের মধ্যে একধরনের বাণিজ্যের নাম বদলি-বাণিজ্য।

গওহর নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণকর্মী