আমরা কি অনুদার গণতন্ত্রের পথে হাঁটছি?

বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি বইটির প্রচ্ছদ
বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি বইটির প্রচ্ছদ

বাংলাদেশের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো, যা এ অঞ্চলের অনেক দেশে নেই। এ দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষের ভাষা এক, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মবিশ্বাস এক। অর্থাৎ একটি সমজাতিক (হোমোজিনাস) রাষ্ট্র হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো এখানে আছে। তারপরও রাষ্ট্রটির চরিত্র বা স্বরূপ নিয়ে আছে নানা তর্ক, বিভ্রান্তি এবং ঝগড়া।

গত ৪৭ বছরে আমরা পাড়ি দিয়েছি অনেকটা পথ। আমরা কত দূর এগিয়েছি বা আরও কত দূর যেতে পারতাম, এ নিয়ে আছে নানান মত। নির্বাচন কাছাকাছি এলে আমরা অনেকেই এ নিয়ে বিতর্কে-কুতর্কে ঝাঁপিয়ে পড়ি। একদল মানুষ বলবে, আমরা দুধ ও মধুর সাগরে ভাসছি। অন্য একদল বলবে, আমরা রসাতলে যাচ্ছি। একদল বলবে, আমরা বিশ্বের রোল মডেল, অন্য দল বলবে, আমাদের রাষ্ট্র অকার্যকর।

রাজনীতিবিদেরা রাষ্ট্র ও সমাজকে যেভাবে দেখেন ও আলোচনা করেন, সমাজবিজ্ঞানীরা তেমনভাবে দেখেন না, বলেন না। সমাজ নিয়ে সমাজের মানুষ নিয়ে যাঁরা চিন্তাচর্চা বা গবেষণা করেন, তাঁরা ক্ষমতায় কে আছেন বা নেই, তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকদের সম্পর্ক কেমন। এই সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের চরিত্র, সক্ষমতা এবং প্রাসঙ্গিকতা।

১৯৬০-এর দশক থেকে আজ অবধি রাষ্ট্র এবং সমাজ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাষ্ট্রের চরিত্র নিয়ে তাত্ত্বিক ধারণা তৈরি হয়, এমন গবেষণা। অনেক গবেষণাগ্রন্থে বলা হয়েছে যে আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা নির্ভর করছে বা টিকে আছে একধরনের ‘প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট’ সম্পর্কের ওপর। এর যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ এ মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছি না।

লাতিন শব্দ ‘পাতের’ থেকে ‘পাত্রনাস’ এবং ‘প্যাট্রন’ শব্দের উৎপত্তি ‘পাতের’ একধরনের স্ল্যাং বা গালি। ‘পাতের’ শব্দের অর্থ পিতা। কিন্তু ইয়ার্কি-ফাজলামো করে আমরা অনেক সময় বলি—বাপের তালুক পেয়েছিস নাকি? গ্রিক পুরাণে ‘প্যাট্রন গডেস’ হিসেবে দেবী অ্যাথেনার স্থান খুব উঁচুতে। প্যাট্রনরা উঁচুতেই থাকেন। তাঁদের আশীর্বাদে অনেক কিছুই হয়। তাঁরা নারাজ হলে ঘোর অন্ধকার।

রাষ্ট্র আশীর্বাদ বিলায়। যাঁরা রাষ্ট্র চালান, তাঁরা পছন্দের লোক বা গোষ্ঠীকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের আনুগত্য পান। তৈরি হয় অনুগ্রহজীবী শ্রেণি। অনুগ্রহপ্রত্যাশীরা দিনরাত প্যাট্রন বা পৃষ্ঠপোষকের নাম জপ করেন। প্যাট্রন হয়ে ওঠেন মহামহিম, দেবতুল্য। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি কি ওই পর্যায়ে চলে গেছে? একটি বই পড়তে পড়তে মনের মধ্যে এ ধরনের ভাবনা তৈরি হলো। বইটির নাম বাংলাদেশ: পলিটিকস, ইকোনমি অ্যান্ড সিভিল সোসাইটি। লেখকের নাম ডেভিড লুই। তিনি ইংরেজ।

বিদেশিরা যখন আমাদের নিয়ে লেখেন বা বলেন, আমরা তাতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দিই। তাঁদের লেখা বা কথা যদি আমাদের পছন্দের সঙ্গে মিলে যায়, আমরা খুব খুশি হই। ওই সব কথা বেশি বেশি প্রচার করি। বলি, দেখ বাঙালি দেখ, বিদেশিরা আমাদের কত প্রশংসা করছে! সমালোচনা তো শুধু দেশের ভেতরেই! আবার বিদেশিদের কোনো কথা বা লেখা পছন্দ না হলে আমরা বলি, ব্যাটা জানে কী? আমাদের এত অর্জন ওর চোখে পড়ল না? এ নির্ঘাত বিদেশি ষড়যন্ত্র।

ডেভিড লুই ১৯৮০-এর দশকে এ দেশে এসেছিলেন পিএইচডি-ছাত্র হিসেবে গবেষণার কাজ করতে। ৯০-এর দশকে এ দেশে কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। এখন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সে সামাজিক নীতি ও উন্নয়ন বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের প্রথম চার দশক নিয়ে লেখা তাঁর এ বইটি ২০১১ সালে বিলেতে ছাপা হয়েছিল। সম্প্রতি এটি ছেপেছে প্রথমা প্রকাশন।

তো কথা হচ্ছিল প্যাট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক নিয়ে। এ বিষয়ে বিআইডিএসে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। স্থানীয় সরকার কাঠামোকে ব্যবহার করে এবং দেদার টাকা খরচ করে কীভাবে একের পর এক সরকার জনভিত্তি তৈরি করে, সে আলোচনা চলে আসছে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের আমল থেকে। পদ্ধতিটি আজ অবধি বদলায়নি।

আমাদের সংবিধানে গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার, সমতা—এসব সুন্দর সুন্দর কথা আছে অনেক। সংবিধান হলো রাষ্ট্রের ‘ইচ্ছার’ প্রকাশ। রাষ্ট্র ঘোষণা দিলেই তার বাস্তবায়ন হয়ে যাবে, এমন কোনো কথা নেই। ধরা যাক, রাষ্ট্রের একটি নীতি হলো ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বিতরণ করা। আমরা দেখি, ভূমিহীনদের জন্য অনেক জায়গায় গুচ্ছগ্রাম তৈরি হয়েছে। ব্যারাকের মতো লম্বা ঘর বা আলাদা আলাদা খুপরি বানিয়ে সেখানে তাঁদের রাখা হয়। আবার দেখা যায়, অনেকেই শত শত বা হাজার হাজার বিঘা জমি ইজারা পাচ্ছেন সরকার থেকে। কে হাজার বিঘা জমি ইজারা পাবেন আর কার গন্তব্য হবে খুপরি ঘরে, সে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের বা সরকারের।

ডেভিড লুই ‘প্যাট্রন স্টেট’-এর  কথা বলেছেন। যেমন সম্পদ বিতরণ ও ভোগের ব্যাপারে রাষ্ট্র কীভাবে কলকাঠি নাড়ে। নাগরিকেরা অনেক সেবা পান না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রশ্নটি জড়িত। সক্ষমতা তো এক দিনে তৈরি হওয়ার বিষয় নয়। তবে যে জিনিসটা ভাবায়, সেটা হলো রাষ্ট্রের গা ছাড়া ভাব। এখানে চলে আসে ‘এইড-ইন্ডাস্ট্রি’ বা সাহায্য শিল্পের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ রাষ্ট্র সব নাগরিকের চাওয়া-পাওয়ার দায় নেয় না। অনেক দায়িত্ব ছেড়ে দেয় এনজিওগুলোর হাতে। এনজিওগুলোর ভূমিকা অনেকটা ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’-এর মতো। ব্যক্তি খাতের যত বিকাশ হবে, সেবার আউটসোর্সিং ততই বাড়বে। এই মডেলে নাগরিকদের বিবেচনা করা হয় নিছক ‘ভোক্তা’ হিসেবে।

এ দেশে এনজিওরা কাজ করছে শত বছর ধরে। স্বাধীনতার পর থেকে এনজিওর সংখ্যা ও কাজের পরিধির উল্লম্ফন দেখা গেছে। অনেক এনজিও সুষ্ঠু ভোক্তা সেবা নয়, রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণেও অংশ নিতে চায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা সম্ভবও হয়েছে। সামরিক সরকারগুলো অনেক সময় এলিট রাজনীতিবিদদের পাশ কাটিয়ে এনজিও বা কোম্পানির মাধ্যমে একধরনের ভিত্তি বা বৈধতা পেতে চায়। জেনারেল এরশাদের আমলে জারি হওয়া ‘ওষুধনীতি’ একটি উদাহরণ, যেখানে এনজিওরা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্রঋণ সরকার-এনজিও সহযোগিতার আরেকটি উদাহরণ। তবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে এনজিওগুলোর নাক গলানোর ব্যাপারে রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের আছে নানান ওজর-আপত্তি! তাঁরা চান এনজিওগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।

এনজিওলোর মধ্যেও এসেছে অনেক পরিবর্তন। তাদের ঝোঁক এখন টাকা বানানোর দিকে। এ ছাড়া তারা অনেকেই সমালোচিত হয় পশ্চিমা ধ্যানধারণা, আধুনিক পুঁজিবাদ ও নয়া সাম্রাজ্যবাদের বাহন হিসেবে। একদা সামরিক সরকারগুলোর গণভিত্তি তৈরিতে সাহায্যকারী এসব এনজিও রাজনৈতিক সরকারের জমানায় রীতিমতো অপাঙ্‌ক্তেয়, অচ্ছুত।

ডেভিড লুইয়ের গবেষণাগ্রন্থে বাংলাদেশের প্রথম চার দশকের পথচলার একটি ছবি পাওয়া যায়। এটি কোনো ইতিহাসের বই নয়। এটি একজন বিদেশি গবেষকের চোখে বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা। রাষ্ট্রের শুরুটা হয়েছিল অনেক আশা আর স্বপ্ন নিয়ে। মাঝে সামরিক শাসনের কারণে যাত্রাপথে নানান পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯১ সালে হয়েছিল গণতন্ত্রের নবায়ন পথে নতুন অভিযাত্রা। ক্রমে তা হয়ে উঠেছে ‘অনুদার গণতন্ত্র’। সিভিল সমাজের আদর্শ ধারণা থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে। এ দেশে তৈরি হয়েছে একধরনের ‘আনসিভিল’ বা ‘কুশীল’ সমাজ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘মাস্তানতন্ত্র’। সমাজে গড়ে উঠেছে একটি পরজীবী শ্রেণি। এরা দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ঘটায়, চাঁদাবাজি করে। নানান ছলচাতুরীর মাধ্যমে ভোটব্যাংক ঠিক রাখে বা নিয়ন্ত্রণ করে। পুরো ব্যবস্থাটি তৈরি হয়েছে এবং চালু আছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিলি-বণ্টনের মাধ্যমে।

মহিউদ্দিন আহমদ, লেখক ও গবেষক
[email protected]