'শিশুদের জন্য আমরা'

আমরা যাঁরা সাধারণ মানুষ, তাঁদের প্রায় সবাই আত্মপরতায় বাঁচতে চাই। পরার্থে জীবন উৎসর্গের বিষয়টি থেকে যায় বাক্যবন্ধনীতে। এই আত্মপরতাই স্বার্থপরতায় রূপ নেয়। মনুষ্যত্ব লোপ পেতে থাকে। অথচ বিষয়টি আমরা টের পাই না। ঠাঁইহীন, দিশাহীন, পথশিশুদের ক্ষুধাও আমাদের গভীরভাবে স্পর্শ করে না। আশার কথা হলো, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মধ্যে কিছু অসাধারণ মানুষ আছেন। তাঁদের কারণে মনে হয় সভ্যতা-ভব্যতা-মনুষ্যত্ব শেষ হয়ে যায়নি।

এই রকমের একজন অসাধারণ মানুষ হলেন হাজেরা বেগম। পথশিশু হিসেবে তাঁর শৈশব কেটেছে পথে পথে। পিতৃমাতৃ স্নেহবঞ্চিত জীবন কেমন, তা তিনি জানেন। হয়তো এই উপলব্ধি থেকেই তিনি পথশিশুদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন অন্য রকম একটি পরিবার। তিনি এখন এসব পথশিশুর মা। বর্তমানে তাঁর ‘সন্তানের’ সংখ্যা ৪০। ২০১০ সালে কয়েকটি পথশিশু নিয়ে তিনিই এই পরিবার গড়ে তোলেন। হাজেরা বেগমের এই পরিবারের নাম ‘শিশুদের জন্য আমরা’। পরিবারের শিশুদের হাসি-আনন্দ, মান-অভিমান, পড়াশোনা, খেলাধুলা আর ছোট ছোট খুনসুটি ও দুষ্টামিতে দিন কেটে যায়। দিন কাটে হাজেরার স্নেহ-মমতায়।

‘শিশুদের জন্য আমরা’ পরিবারের প্রতিষ্ঠার ৯ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে শুক্রবার বিকেলে আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে যে শুভানুধ্যায়ী সম্মিলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল, তা কমবেশি সবার চেতনাকে নাড়া দিয়ে গেছে। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো অনুপ্রাণিত হয়েছে।

মা হাজেরা বেগম তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আমার স্বপ্ন একটাই, এই বাচ্চারা যেন মানুষের মতো মানুষ হিসেবে এই সমাজে বেড়ে ওঠে। তারা সমাজের জন্য ভালো কিছু করে।’ তাঁর এই বক্তব্য মাদার তেরেসা কিংবা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা মনে করিয়ে দেয়। অর্থ ও সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় শুধু প্রচণ্ড মনের জোর দিয়ে হাজেরা তাঁর ‘পরিবার’ শুরু করেছিলেন। আজ সেটি একটি সাংগঠনিক চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানেই মহৎ চিন্তার সাফল্যের স্বাক্ষর পাওয়া যায়।

আজকের পৃথিবীতে এক দিকে দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার বিস্তৃতি, সমাজ-সভ্যতার সম্প্রসারণ; অন্য দিকে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, স্খলন-পতন-বীভৎস কার্যকলাপের তামসিক উল্লাসে প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত শুভচেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধ। ঠিক এ রকম সময়ে ‘শিশুদের জন্য আমরা’ একটি আশাবাহী দৃষ্টান্ত। এই ধরনের উদ্যোগকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে উৎসাহিত করা দরকার। পথশিশুদেরও যে মানবিক অধিকার আছে, তাদের প্রতি সমাজ ও রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা আছে, সেই বার্তা সকল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া দরকার।