তদন্ত কমিটি ও তার প্রতিবেদন সমাচার

একবার সিলেট থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। একদল পদস্থ কর্মকর্তা যাচ্ছিলেন ঢাকা থেকে মৌলভীবাজার বা সিলেট। একটি হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় আমাদের দেখা। হাইওয়ের কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় খাবার উপভোগ্য, দাম কিছুটা বেশি হলেও। কথা প্রসঙ্গে জানালেন তাঁদের সফরের উদ্দেশ্য। বললেন, একটি তদন্ত কমিটির সদস্য তাঁরা। ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন সরেজমিনে দেখতে। আমি তাঁদের বললাম, তাঁদের এই দৌড়াদৌড়ি স্রেফ পণ্ডশ্রম হবে। না-হক কষ্ট করছেন। বললাম, আপনারা যে রিপোর্ট রচনা করবেন তা পাঠ করার মতো সময় কারও হবে না।

নেতৃস্থানীয় একজন বললেন, তা জানি। তবু দায়িত্ব যখন দেওয়া হয়েছে, আমাদের কাজ আমরা করি। আমরা চাকরি করি, নির্দেশ তো মানতেই হবে। নির্দিষ্ট সময়ে রিপোর্ট জমা না দিয়ে উপায় কী?

আমি বললাম, অতি সহজ ও উত্তম উপায় আছে। বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। সম্ভব হলে তদন্তের সময় আরও দশ কর্মদিবস বাড়িয়ে নিন। কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করে নিন। তারপর মীর মশাররফ হোসেনের
বিষাদ-সিন্ধু অথবা মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা উপন্যাস থেকে ৭০-৮০ পৃষ্ঠা টাইপ করে সুন্দর করে বাঁধাই করে জমা দেবেন। নিশ্চিত থাকুন, কোনো তদন্ত রিপোর্টের পাতা কেউ ওলটান না। দেখবেন ওটা জমা দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ সংবাদমাধ্যমকে বলবে ‘তদন্তের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।’

আমার কথা শুনে হাসতে হাসতে এক কর্মকর্তা বললেন, ‘অবস্থা সে রকমই।’ তারপর বিলাসবহুল গাড়িতে উঠে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দিলেন।

রাষ্ট্রে কোথাও কোনো বড় অনিয়ম হলে, কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে অথবা কোনো চাঞ্চল্যকর দুর্নীতি হলে, সরকার তার কার্যকারণ জানতে তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত কমিটি বা তদন্ত কমিশন গঠন করে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু, পাকিস্তানি আমলেও তা হয়েছে, এখনো হয়। কখনো বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন হতো। সেকালে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা ছিল। ব্রিটিশ সরকার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করত। শুধু প্রকাশ নয়, কমিশন যেসব সুপারিশ করত তা সাধ্যমতো বাস্তবায়নও করত।

অনেক সময় সরকারি তদন্ত কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা থাকে না। যেমনটি হয়েছিল ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ও সরকারি দমননীতির সময়। ইতিহাসের জঘন্যতম ওই হত্যাকাণ্ডের পর সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। সেই তদন্ত কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা
ছিল না। তখন ভারতবর্ষের প্রধান দল কংগ্রেস আর একটি বেসরকারি তদন্ত কমিশন গঠন করে। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন গান্ধীজি। সেখান থেকেই তিনি পাদপ্রদীপের আলোতে আসেন। ওই তদন্ত কমিশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন দুই বাঙালি জননেতা ও আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশ ও এ কে ফজলুল হক।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে নির্মম ঘটনাটি ঘটে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সরকার বিচারপতি এলিসকে দিয়ে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে। মাননীয় বিচারপতি যথাসময়ে তাঁর প্রতিবেদন পেশ করেন। যদিও তিনি তাঁর প্রতিবেদনে গুলি করে হত্যা করার যথার্থতা দেখান, তবু সরকার প্রতিবেদনটি লুকিয়ে রাখে। বহুদিন সেটা আলোর মুখ দেখেনি। তবে তাতে কিছুই যায়-আসে না। বাংলার মানুষ নিজের চোখে প্রকৃত ঘটনা দেখতে পেয়েছে এবং কোনো তদন্ত কমিশনের মতামতের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই সিদ্ধান্ত
নিয়ে নেন।

স্বাধীনতার পর থেকে গত হপ্তা পর্যন্ত বাংলাদেশে শ খানেকের বেশি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। যথাসময়ে কমিটি তার প্রতিবেদন জমাও দিয়েছে, কিন্তু সেই সব প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি। আমাদের দেশের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যেন ‘একান্ত গোপনীয়’ বিষয়। তদন্ত কমিটির কাজ সত্য উদ্‌ঘাটন করা। ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের শনাক্ত করা। বিচার করার মালিক সরকার, শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। তদন্ত কমিটি শুধু সুপারিশ করতে পারে।

বিভিন্ন ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ৯৯ ভাগ তদন্ত কমিটি গঠিত হয় ক্ষুব্ধ জনগণকে শান্ত করতে বা সান্ত্বনা দিতে। বাঙালি ৫০ বছর আগে যতটা বেকুব ছিল, আজ আর তা নেই।  সে সবই বোঝে, কিন্তু তার করার কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের চাঞ্চল্যকর রিজার্ভ পাচার নিয়ে সরকার সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করেছেন এবং বর্তমান সরকারের একজন হিতার্থী। বাহাত্তর থেকে আমি তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে জানি, তিনি একজন সৎ, সজ্জন, দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ। যথাসময়ে তিনি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। বোধগম্য কারণে তাঁর সেই রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিবেদনটি প্রকাশ করলে বাংলাদেশ ব্যাংক যতটা বিব্রত হতো, সেটি গোপনে তালা মেরে রাখায় সরকার অনেক বেশি সন্দেহভাজনে পরিণত হয়েছে। প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে।

গ্যাস-জ্বালানি খাতে দুর্ঘটনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে সরকার কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। টেংরাটিলা দুর্ঘটনায় দুই দফা তদন্ত হয়। ভালো রিপোর্টই ছিল। মাগুরছড়ার অক্সিডেন্টাল নিয়ে তদন্ত হয়েছে। এশিয়া এনার্জি নিয়ে বুয়েটের অধ্যাপক নূরুল ইসলামকে দিয়ে বিএনপি সরকার তদন্ত করায়। রিপোর্ট সরকারিভাবে প্রকাশ না হলেও, অন্যভাবে জানাজানি হয়। তখন আমরা আন্দোলন করছিলাম। তাতে বলা হয়েছিল এশিয়া এনার্জির চুক্তিটি আইনগতভাবে যথাযথ নয়, পরিবেশগতভাবে ভয়ংকর ক্ষতিকর এবং অর্থনৈতিকভাবেও মোটেই লাভজনক নয়। ওই পর্যবেক্ষণ সেই সরকারের পছন্দ হয়নি, পরের সরকারেরও নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সোনা নিয়ে কিসের মধ্যে কী ঘটেছে, তার তদন্তেও কমিটি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তার মতো তদন্ত করছে। প্রকৃত সত্য কোনো দিনই যে উদ্‌ঘাটিত হবে, তা সাধারণ মানুষ মনে করেন না। যাঁরা তদন্ত করেন তাঁরাও মানুষ। তাঁদেরও চাকরিবাকরি ও জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম হলে কোনো কাজই হয় না।

বড়পুকুরিয়ার কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। সাবেক চার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আপাতত ফেঁসে গেছেন। জনগণের চোখ এখন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের দিকে। কোনো নিরপরাধ অভিযুক্ত হোক সেটা কারও কাম্য নয়। সরকারের বাইরে জনগণের দিক থেকেও একটি সত্যানুসন্ধানী তদন্ত হবে। তবে তার পর্যবেক্ষণ আমলে নেওয়া না-নেওয়া সরকারের মর্জি।

তদন্ত করতেও রাষ্ট্রের খরচা হয়। সে টাকা জনগণের করের টাকা। সুতরাং তদন্তের ফলাফল জানা জনগণের মৌলিক অধিকার। তদন্ত কমিটি করা হয় নানা উদ্দেশ্যে। সত্য উদ্‌ঘাটন করা এবং একই রকম ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ। কোনো প্রসঙ্গে মিথ্যা অনেক রকম হতে পারে, কিন্তু সত্য একটিই। সেই সত্যটি উদ্‌ঘাটিত হলে মিথ্যা দূর হয়ে যায়। সে জন্য সরকারের নৈতিক দায়িত্ব যেকোনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা এবং বিবেচনা করা কমিটির সুপারিশমালা। তাতে ব্যক্তিগতভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও সরকারের কোনো ক্ষতি নেই।

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক